দুই বছর আগে ২০১৯ সালে স্বাক্ষরিত তুরস্ক-লিবিয়ার অর্থনৈতিক চুক্তিকে কেন্দ্র করে দু'পক্ষের উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে উঠে। স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে তুরস্কের দক্ষিণ উপকুল থেকে লিবিয়ার উত্তর-পূর্ব তীর পর্যন্ত একটি বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে গ্রীসের 'ক্রিটি' দ্বীপকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। ফলে গ্রীস ক্ষিপ্ত হয়। ভূমধ্যসাগরে আধিপত্য হ্রাসের আশঙ্কায় মিশরও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় এতে। ইসরাইল এবং গ্রীস এ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আমেরিকার শরণাপন্ন হলে শুরু হয় অত্র অঞ্চলে তুরস্কবিরোধী তৎপরতা। তুর্কি চুক্তির বিপরীতে যুতসই পদক্ষেপ হিসেবে গত বছরের আগস্টে গ্রীস-মিশর একটি নতুন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়, যেখানে তুর্কি অর্থনৈতিক অঞ্চলকে অস্বীকার করা হয়। ফলে ভূমধ্যসাগরব্যাপী উত্তেজনা দেখা দেয়। তবে উত্তেজনা সামরিক সংঘাতে পরিণত হওয়ার আগেই বিচক্ষণ এরদোয়ান 'ব্যাক ডোর ডিপ্লোম্যাসি' পরিচালনা করে সিসিকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, গ্রীসের সাথে চুক্তির বিপরীতে তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি করলে ভূমধ্যসাগরে মিশরের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিমাণ ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটার বেড়ে যাবে। কায়রো এতে 'সবুজ সংকেত' দেয়। শুরু হয় দু'পক্ষের গোপন চিঠি চালাচালি। এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি মিশর ভূমধ্যসাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের যে টেন্ডার দেয়, তাতে তুরস্ক ঘোষিত অঞ্চলকে মেনে নিয়ে তা নিজের জলসীমায় দেখায়নি।
![]() |
মিশর-তুরস্ক সম্পর্ক |
.
স্বভাবতই দু'দেশের সম্পর্কের এই অগ্রগতি মিশরের মিত্র কোন দেশ চায়নি। তবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া গ্রীস ছাড়া কেউ তেমন একটা দেখাতে পারেনি; এবং তা নিজ নিজ স্বার্থেই। কায়রোর কূটনীতির এমন নাটকীয় পরিবর্তন মেনে নিতে না পেরে গ্রীক পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিন বার এবং প্রধানমন্ত্রী একবার মিশর সফর করে কায়রোর মনোভাব পরিবর্তনের আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে কায়রো এবার নিজ অবস্থানে অনড়। আর এতে ক্ষিপ্ত হয়ে গ্রীক মিডিয়া ইতোমধ্যেই মিশরকে বিশ্বাসঘাতকতার তকমা দিয়েছে। এছাড়া মিশরের ছদ্মবেশী মিত্ররা তাদের মনঃক্ষুণ্ণতার ইঙ্গিত দিয়েছে সম্প্রতি নিজেদের (সাইপ্রাস, গ্রিস, আরব আমিরাত, ইসরাইল) মধ্যকার পররাষ্ট্র পর্যায়ের একটি বৈঠক মিশরকে আমন্ত্রণ না জানিয়ে।
.
.
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অতীতে মিশরের সাথে তার মিত্ররা কতটুকু বিশ্বাস রক্ষা করেছে, তার হিসেব কষেই কায়রো এবার নিজ পথে চলছে। অতীত ঘাঁটলে দেখা যাবে, মিশরের সামরিক জান্তার দুর্বলতার সুযোগে অনেক দেশ মিশরকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে এবং স্বার্থ শেষে সিসি সরকারকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থার (জিসিসি) সদস্য সৌদি, আমিরাত ও বাহরাইনের সাথে মিশর মিলে যে ‘কাতার অবরোধ’ করেছিল, তার অবসানে মিশরকে কোন গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। যে আমিরাত মিশরকে লিবিয়াতে তুরস্কের বিরুদ্ধে ইন্ধন যুগিয়েছিল, তারাই এখন তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সক্রিয়। ইসরাইলকেও তুরস্কের বিরুদ্ধে তেমন উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়নি। কেননা ইসরাইল থেকে ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহকারী ১,৯০০ কিলোমিটারব্যাপী প্রায় সাত বিলিয়ন ডলার মূল্যের ইষ্টমেড পাইপলাইন প্রকল্প তুরস্কের দাবি করা অঞ্চল দিয়েই যাবে। ফলে প্রকল্পটিকে ‘দিনের আলো' দেখাতে ইসরাইল নিজ স্বার্থেই মিশর-তুরস্ক সম্পর্কের বিরোধিতা করছে না।
![]() |
মিশর-তুরস্ক সম্পর্ক |
.
ভূমধ্যসাগরে ইসরাইল, গ্রীস, ফ্রান্স ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আহ্বানে তুর্কি বিরোধী জোটে মিশর যোগ দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে ইসরাইল তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পথে এগুচ্ছে, গ্রীস সম্প্রতি তুরস্কের সঙ্গে পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথম ওপেন বৈঠক করেছে। ফ্রান্সও তুরস্কের প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শন করছে। ফলস্বরূপ ইউরোপীয় ইউনিয়ন তুরস্কের সঙ্গে বড় ধরণের ঝামেলায় জড়াবে না বলে জানিয়েছে। জোট সদস্যদের এসব কর্মকাণ্ডে মিশরের কোন মতামত চাওয়া হয়নি এ পর্যন্ত। অথচ মিশর জোটে যোগ দিতে গিয়ে অনেক স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছে। এর প্রেক্ষিতেই এখন কায়রো গ্রীসকে উপেক্ষা করে নিজ পথে অগ্রসর হচ্ছে বলে ধারণা করা যায়।
.
.
চলমান মিশর-তুরস্ক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ আচমকা ঘটিত কোন ঘটনা নয়, দু'দেশের মাঝে গোয়েন্দা পর্যায়ে গোপন যোগাযোগের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্পর্কও ছিল আগে থেকে। যার ভিত্তিতে প্রাক-করোনাভাইরাস সময়কালে আঙ্কারা কায়রোকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং গ্যাস আমদানির পরিমাণ বাড়াতে প্রস্তাব করেছিল। দ্বিপাক্ষিক এই বাণিজ্য ২০১৮ সালেই পাঁচ বিলিয়ন ডলারকে অতিক্রম করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ শুরু হয়েছে।
![]() |
মিশর-তুরস্ক সম্পর্ক |
.
গত ১২ মার্চ তুর্কি প্রেসিডেন্ট সর্বপ্রথম দুই দেশের মধ্যেকার যোগাযোগের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরেন। পরবর্তীতে ৫ ও ৬ মে মিশরের রাজধানী কায়রোয় দু'দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে বৈঠক দেখতে পায় বিশ্ববাসী। এই আলোচনার কোন পূর্বশর্ত নেই বলা হলেও ধারণা করাই যায়; সমুদ্রসীমা নিয়েই দুপক্ষের মূল আগ্রহ। বিশ্লেষকদের মতে, মিশরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তারা গ্রিসের চেয়েও তুরস্কের সাথে একটি সমুদ্র চুক্তির প্রতি বেশি আগ্রহী। আর উভয় পক্ষের মাঝে সমুদ্রসীমা নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে গ্রিস-মিশর চুক্তি অনেকটা অকেজো হয়ে পড়বে এবং তুর্কি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। ফলস্বরূপ গ্রীস-সাইপ্রাসের মাঝে কোন সমুদ্রসীমা থাকবে না।
.
.
সমুদ্রসীমা ছাড়া আরও কিছু কারণে মিশর তুরস্কের সাথে নতুন চুক্তিতে আগ্রহী। সৌদি, আমিরাত ও বাহরাইনের কাতার অবরোধ তুলে নিয়ে তুরস্কের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে সচেষ্ট হওয়া, লিবিয়া যুদ্ধের অবসান ও জ্বালানি উত্তোলন চুক্তিতে বাড়তি সুবিধা ভোগের মতো বিষয়গুলো মিশরকে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে প্রভাবিত করেছে। এছাড়া বিপুল খনিজ সম্পদ আবিষ্কার এবং সামরিক অগ্রগতি তুরস্ককে মূল্যায়নে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কৃষ্ণ সাগরে গত বছর ৪০৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বিশিষ্ট খনির সন্ধানের পর সর্বশেষ গত ৪ জুন ১৩৫ মিলিয়ন ঘনফুটের আরেকটি গ্যাসের খনি প্রাপ্তির কথা জানিয়েছে তুর্কি কর্তৃপক্ষ।
![]() |
মিশর-তুরস্ক সম্পর্ক |
.
এসবের বাইরে নীল নদের উজানে ইথিওপিয়ার আননাহদা (রেনেসাঁ) বাঁধ চালুর বিষয়টি সিসির সামনে উপস্থিত বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে। উভয় দেশই কৃষির জন্যে বহুলাংশে নীল নদ নির্ভর। বর্তমানে ইথিওপিয়া মিশর ও সুদানের সমঝোতা ছাড়াই বাঁধটি নির্মাণ করছে, যা থেকে মিশর এককভাবে প্রভাব খাটিয়ে ইথিওপিয়াকে নিবৃত্ত করতে পারছে না। এক্ষেত্রে ধারণা করা যায়, মিশর-ইথিওপিয়া-সুদানের মধ্যকার বাঁধ সম্পর্কিত বিবাদ নিষ্পত্তিতে তুরস্ক কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে। তুরস্ক ইতোমধ্যে এ বিষয়ে মধ্যস্থতার প্রস্তাবও দিয়েছে।
.
.
এই ঘটনাগুলোর এবং কায়রোর ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ কষে আঙ্কারা পূর্ব ভূমধ্যসাগর ও লিবিয়ায় তাদের সাধারণ স্বার্থের ভিত্তিকে নীরবে মূল্যায়ন করছে। আর আঙ্কারার সাবধানে তৈরি করা বার্তাগুলো এখন একেকটি বিজয়ী সূত্র হিসেবে কাজ করছে। তুরস্কের সাথে সহযোগিতার মধ্যে কায়রোর স্বার্থের বিষয়টিও সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে কৌশলে। তবে এসবের বাইরে এরদোয়ানের প্রতি সিসি সরকারের অঘোষিত একটি দাবি হল, মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করা কিংবা তুরস্কে আশ্রিত ব্রাদারহুড নেতাদের ফেরত দেয়া। কিছু নেতাকে গোপনে হস্তান্তরের কথা শোনা গেলেও আনুষ্ঠানিকভাবে তুরস্ক কখনো এই দাবি মেনে নেবে না। কারণ এরদোয়ান নিজেই একজন গণতান্ত্রিক নেতা, যিনি সামরিক শাসন বিরোধী। ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করলে তা নিজ আদর্শের সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা হবে বৈকি। এছাড়া নিষিদ্ধ করে মুসলিম বিশ্বের বৃহৎ এই আন্দোলনকে কখনো স্তিমিত করা যাবে না, তাই এর বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের ভবিষ্যতকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইবেন না এরদোয়ান।
![]() |
মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসি |
.
সর্বোপরি মিশর ও তুরস্ক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির যেসব ক্ষেত্রে দুই দেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সেসব ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করবে। দুই দেশের সম্পর্কের এই নতুন মোড়ের ইতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যেই আমরা লিবিয়ায় দেখতে পাচ্ছি। সেখানে দু'পক্ষের মাঝে সমঝোতা হয়েছে এবং রাজধানী ত্রিপলিতে মিশর দূতাবাস খোলার কার্যক্রম শুরু করেছে। এছাড়া যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় রয়েছে দু'দেশের নিয়ন্ত্রণ সক্ষমতা। লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে রয়েছে মিশরের সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি। সেখানে যেকোন উত্তেজনা প্রশমনে মিশর তার সামরিক বাহিনীকে কাজে লাগাতে পারবে। অন্যদিকে রাজধানী ত্রিপোলিতেও কোনো ধরনের উত্তেজনা দেখা দিলে তুরস্ক তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে। ফলে চলমান মিশর-তুরস্ক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক রূপ পেলে লিবিয়ার পুনর্গঠনও দ্রুততর হবে বলে আশা করা যায়। তদুপরি এই সম্পর্কের ফলে সর্বাধিক আশীর্বাদপুষ্ট হবে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠী, যারা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে।
![]() |
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান |
.
তবে আবেগ এবং নীতি কথা অনেক সময় রাষ্ট্রস্বার্থের কাছে হার মেনে যায়। আর সে রাষ্ট্রের নেতা যদি হন এরদোগানের মত বাস্তবাদি একজন প্রেসিডেন্ট, তবে সম্পর্ক কখন কতটুকু স্বাভাবিক হবে তা বোঝা একটু মুশকিলই বটে।
0 comments:
Post a Comment
Please do not enter any spam link in the comment box.