.
সিরিয়া সংকটের এক দশক ও চাওয়া পাওয়া
.
২০১১ সালের মার্চে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর জুলাইয়ে সিরিয়া সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত এক কর্নেল তুরস্কের সহায়তায় ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (এফএসএ) গঠন করেন।১৯৮২ সালে বাশারের বাবা হাফিজ আল আসাদ মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর সামরিক অভিযানের আদেশ দিয়ে হাজারো মানুষকে হত্যা করার জেরে ব্রাদারহুডের কর্মীরাও ফ্রি সিরিয়ান আর্মিতে যোগ দেয়। এরপরই তারা সশস্ত্র বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে দখলে নেয় আলেপ্পো ও হোমস শহরের বেশকিছু এলাকা।
.
.
২০১২ সালে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনা করে আসাদ সরকার। ওই বছরের জুলাইয়ে এফএসএ যোদ্ধারা দামেস্ক দখলে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আসাদ সরকার রাজধানী দখলে রাখতে পারলেও বিদ্রোহীরা শহরতলির অংশবিশেষের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর ২০১৩ সালের আগস্টে দামেস্কের কাছে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত দুটি এলাকায় রাসায়নিক হামলা চালানো হয়, এতে মারা যায় ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষ। ওই বছরই ইরানের মদদপুষ্ট লেবাননের শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ জানায়, তারা সিরীয় সরকারকে সহায়তায় যোদ্ধা মোতায়েন করেছে। ইরানও আসাদের প্রতি সমর্থনের কথা জানায়। এরপর ২০১৪ সালের জুনে ইসলামিক স্টেট গ্রুপের (আইএস) ওই অঞ্চলে খেলাফত ঘোষণা, সেপ্টেম্বরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের আইএসের বিরুদ্ধে হামলা এবং ২০১৫ সালে অবরুদ্ধ আসাদ বাহিনীর সহায়তায় রাশিয়ার বিমান হামলা চূড়ান্তভাবে সিরিয়াকে এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে।
২০১১ সালের মার্চে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর জুলাইয়ে সিরিয়া সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত এক কর্নেল তুরস্কের সহায়তায় ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (এফএসএ) গঠন করেন।১৯৮২ সালে বাশারের বাবা হাফিজ আল আসাদ মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর সামরিক অভিযানের আদেশ দিয়ে হাজারো মানুষকে হত্যা করার জেরে ব্রাদারহুডের কর্মীরাও ফ্রি সিরিয়ান আর্মিতে যোগ দেয়। এরপরই তারা সশস্ত্র বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে দখলে নেয় আলেপ্পো ও হোমস শহরের বেশকিছু এলাকা।
.
.
২০১২ সালে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনা করে আসাদ সরকার। ওই বছরের জুলাইয়ে এফএসএ যোদ্ধারা দামেস্ক দখলে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আসাদ সরকার রাজধানী দখলে রাখতে পারলেও বিদ্রোহীরা শহরতলির অংশবিশেষের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর ২০১৩ সালের আগস্টে দামেস্কের কাছে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত দুটি এলাকায় রাসায়নিক হামলা চালানো হয়, এতে মারা যায় ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষ। ওই বছরই ইরানের মদদপুষ্ট লেবাননের শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ জানায়, তারা সিরীয় সরকারকে সহায়তায় যোদ্ধা মোতায়েন করেছে। ইরানও আসাদের প্রতি সমর্থনের কথা জানায়। এরপর ২০১৪ সালের জুনে ইসলামিক স্টেট গ্রুপের (আইএস) ওই অঞ্চলে খেলাফত ঘোষণা, সেপ্টেম্বরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের আইএসের বিরুদ্ধে হামলা এবং ২০১৫ সালে অবরুদ্ধ আসাদ বাহিনীর সহায়তায় রাশিয়ার বিমান হামলা চূড়ান্তভাবে সিরিয়াকে এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে।
![]() |
সিরিয়া সংকট |
.
অপরদিকে আমেরিকার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ২০১৩ সালে আসাদবিরোধীদের অস্ত্র, তহবিল ও প্রশিক্ষণের জন্য গোপন কর্মসূচি চালু করে। কর্মসূচির খবর ফাঁস হয়ে হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায় এর কার্যক্রম। তখন শোনা গিয়েছিল, সিআইএ ৫০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। ২০১৪ সালে তারা আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরু করে। বিশ্লেষকেরা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আইএস প্রতিষ্ঠা করে একসাথে সিরিয়া ও ইরাকে নিজেদের প্রবেশ নিশ্চিত করে। এটি অনেকটা সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে নির্মিত ‘বাস্তিল ডে’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যের মতো: যেখানে দেখা যায় বোমা হামলাকারীকে তালাশ করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এক বাড়ির সিলিংয়ে বোমা রেখে নিজেরাই হইচই শুরু করে দেয় ‘বোমা পাওয়া গিছে, বোমা পাওয়া গিয়েছে’ বলে।
.
.
আবার কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, ওবামা প্রশাসনের সিরিয়া ও ইরাকে ঔদাসীন্যের কারণেই আইএসের উদ্ভব হয় এবং এর সুযোগে উক্ত অঞ্চলে রাশিয়া-ইরান-তুরস্ক আধিপত্য বিস্তারের খেলায় মেতে উঠে। এই খেলায় যুক্তরাষ্ট্র তুলনামূলক পিছিয়ে থাকা এবং খরচের তুলনায় লাভের অংশ নগণ্য বিধায় ট্রাম্প প্রশাসন তার শাসনামলের শেষ দিকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেন। তাঁর এই পিছু হঠার সিদ্ধান্তকে অনেকেই সমর্থন করেছিলেন। যেমন ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে ২৫ জানুয়ারি প্রকাশিত এক কলামে মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট রবার্ট এস. ফোর্ড বলেন, ছয় বছরে ২৬০ কোটি ডলার খরচ করার পর উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় আমেরিকা যেসব অনুগত যোদ্ধা তৈরি করেছে তারা নিজেদেরকে রক্ষা করতে সক্ষম নয়। এরা আমেরিকার সুরক্ষায় রয়েছে কিন্তু প্রতিবেশী শত্রুদের হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারবে না। ফলে স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল আমেরিকার সম্পদ ও রসদের ওপর নির্ভরশীল থাকবে। এ অবস্থায় তিনি সিরিয়া থেকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে সেনা প্রত্যাহারের পরামর্শ দেন।
.
তবে বাইডেন বর্তমান বিশ্বের সর্বাধিক নৃশংস তিনটি যুদ্ধপ্রবণ দেশ ইরাক, সিরিয়া ও আফগানিস্তানে নতুনভাবে যুদ্ধ পরিচালনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আফগান-তালেবান চুক্তি অনুসারে আগামী মে মাসের মধ্যেই আফগান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের যে প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে, তা বিলম্বিত হতে পারে বলে জানিয়েছেন বাইডেন। অপরদিকে ইরাকে নতুন মার্কিন ঘাঁটি তৈরি ও চার হাজার আইএস যোদ্ধার অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে পরিস্থিতি এখনো ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে সেখানে নতুনভাবে সেনা রাখার যৌক্তিকতা প্রদর্শন করছে মার্কিন প্রশাসন। এছাড়া ইরাকে নতুন করে আট গুণ ন্যাটো সেনা বাড়ানোর ঘোষণাও দিয়েছে বাইডেন। সর্বশেষ সিরিয়ায় নতুনভাবে মার্কিন সেনা জমায়েত, ইরানি বাহিনীর উপর হামলা, নতুন ঘাঁটি নির্মাণের খবর প্রচারিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। এছাড়া সম্প্রতি মার্কিন সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে নতুনভাবে সংগঠিত করা এবং তুরষ্ককে বারংবার সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একসাথে লড়াই করার আহবান জানাচ্ছে বাইডেন প্রশাসন। মোদ্দ কথা, তুরষ্ককে সাথে নিয়ে সিরিয়ায় শেষ মরণ কামড় বসাতে চায় বাইডেন প্রশাসন। তবে এটি যথেষ্ট কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হবে বৈকি। কেননা রাশিয়া এখনো তুরস্ককে যথাযথ মর্যাদায় নিজের হাতে রেখেছে। সম্প্রতি পুতিনের পক্ষ নিয়ে এরদোয়ানকে বাইডেনের নিন্দায়ও দেখা গেছে। এছাড়াও তুরস্ক-রাশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ বিক্রির পাশাপাশি ২০১৮ সালে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক ২৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল, যা আগামী কয়েক বছরেই ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চাচ্ছে তারা।
.
.
ভৌগলিক অবস্থানগত এবং তিন আব্রাহামিক রিলিজিয়ন অনুসারীদের নিকট গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় পার্শ্ববর্তী ইহুদি, শিয়া ও সুন্নি রাষ্ট্রগুলো সিরিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের খেলায় ছাড় দিতে নারাজ। মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয় গৃহযুদ্ধের আগে অত্র অঞ্চলজুড়ে ছিল মার্কিনিদের একচ্ছত্র আধিপত্য। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে সিরিয়ায় সরকার পক্ষের হয়ে আইএস দমনের অজুহাতে বিমান হামলার মাধ্যমে রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সর্ববৃহৎ হস্তক্ষেপের সূচনা করে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে রাশিয়া তার সামরিক উপদেষ্টা এবং স্পেশাল অপারেশন ফোর্সকেও সিরিয়াতে মোতায়েন করে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সিরিয়ায় সামরিক বাহিনী আলেপ্পোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম বড় একটি জয় পায়। এরপর থেকে এফএসএর নিয়ন্ত্রণ এলাকার সংখ্যা কমতে শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় সিরিয় পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে শুরু করে, দোদুল্যমান আসাদ সরকারের ক্ষমতার আসন স্থিতিশীল হওয়ার পাশাপাশি বিদ্রোহীদের বিপক্ষে আসাদ সরকারের অবস্থানও ক্রমশ শক্তিশালী হতে শুরু করে।
.
আসাদের সরকারের ক্ষমতা সুসংহত করার লক্ষ্যে রাশিয়া এখন পর্যন্ত সিরিয়ায় ৫,০০০ সৈন্য ও কয়েক ডজন যুদ্ধ বিমান প্রেরণ করেছে। এর মাধ্যমে তারা সিরিয়ার তারতাস বন্দর ও ভূমধ্যসাগরে নিজেদের নৌবহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। এভাবে খুব সামান্য বিনিয়োগের মাধ্যমেই রাশিয়া সিরিয়ার সাথে বন্ধুত্ব সৃষ্টির পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতেও সক্ষম হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর প্রথমবারের মতো বিশ্বাঙ্গণে তারা একটি বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের ফলেই। উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও জর্ডানের সঙ্গে সিরিয়ার যুদ্ধবিরতির নেতৃত্ব দিয়েছে মস্কো। এরপর ইদলিব ইস্যুতে তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি করেছে ২০১৮ সালে। ২০১৯ সালে সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে গেলে আরও একটি চুক্তি করে তারা। এছাড়া সিরিয়ায় ইরানের উপস্থিতি নিয়ে ইসরায়েলের মধ্যে যে উদ্বেগ সেটি নিয়েও ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছেন ভ্লাদিমির পুতিন।
.
.
আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে 2017 সালের আস্তানা সম্মেলনে ইরান-তুরস্ক-রাশিয়া চারটি ডি-এস্কেলেশন জোনের উল্লেখ করে, যার তিনটি ইতোমধ্যেই দখল করা হয়েছে। সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ ইদলিব শহর দখল সম্ভব হয়নি এখনো। ইদলিবের আশেপাশে আরো বিস্তীর্ণ এলাকা মার্কিন ও বিদ্রোহী বাহিনীর দখলে রয়েছে, তাই ইদলিব উদ্ধার ব্যতীত বাকি অঞ্চল দখল করা সম্ভ নয়। এছাড়াও জর্ডান থেকে সিরিয়ার ভেতর দিয়ে তুরস্ক যাওয়ার "এম ফাইভ" হাইওয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ পড়েছে ইদলিবে। তাই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইদলিব উদ্ধারে ত্রিশক্তি জোর তৎপরতা শুরু করেছে।
.
.
এদিকে গত কয়েক বছরে সিরিয়া সংকট সমাধানে রাশিয়ার উদ্যোগে যতটুকু আশার আলো দেখেছিল সিরিয়রা, তা যেন আজ পুনরায় মৃয়মান হতে চলেছে মার্কিন নয়া মধ্যপ্রাচ্য নীতির প্রভাবে। ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত রাশিয়া-তুরষ্ক-ইরান-কাতারের বৈঠকে সিরিয়া সংকট সমাধানে যেসব অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়েছিল, তাতে পানি ঢেলে দিয়ে নয়া যুদ্ধনীতি নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ট্রাম্প নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর গর্বের সাথে বলেছিলেন, "আমি আমার শাসনামলে কোন নতুন যুদ্ধ শুরু করিনি, উল্টো যুদ্ধপ্রবণতা কমিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রগুলোকে সঙ্কুচিত করেছি।" এই কথার মাধ্যমে তিনি হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলেন, আপনারা আপনাদের পছন্দের প্রেসিডেন্টের আমলে এর বিপরীত দৃশ্য দেখবেন। পর্যবেক্ষণেও দেখা যাবে, বারাক ওবামার শাসনামলে যুদ্ধ নীতি প্রণয়নে বাইডেনই বেশি ভূমিকা রেখেছিলেন এবং বর্তমানেও তৎকালীন যুদ্ধপ্রিয় ব্যক্তিবর্গকেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক আসনে বসানো হয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের পর বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোও এরবিল, সুলায়মানিয়া, হাসাকেহ, কোবানি ও মানবিজ এলাকায় আতশবাজি ফুটিয়ে বাইডেনের জয়ে উল্লাস করেছিল। তারা মূলত বাইডেনের জয়কে ওবামা প্রশাসনের হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তন এবং ওয়াশিংটনের ক্ষমতাবৃত্তের জয় হিসেবে দেখেছিল। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন তাদের কখনো বন্ধু হিসেবে দেখেনি, বরং সিরিয়ায় মার্কিন পেট্রল কোম্পানির পাহারাদার হিসেবে দেখেছিল। আর এই ইচ্ছাকে বাস্তবেও রূপ দিয়েছে সিরিয়ান কুর্দিরা। গত গ্রীষ্মে মার্কিন এক তেল কোম্পানির সঙ্গে এসডিএফের চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। বিনিময়ে পেট্রল বিক্রির এই অর্থের পাশাপাশি মার্কিনরা ২০২০ সালে ৩০০ মিলিয়ন এবং ২০২১ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে ২০০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য বরাদ্দ করেছে এসডিএফের জন্য। বিপুল পরিমাণ এই আর্থিক ও সামরিক সাহায্যের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান বাইডেন প্রশাসনের মদদ নতুনভাবে মার্কিন আধিপত্য বিস্তারেরই ইঙ্গিত বৈকি।
.
বর্তমানে সিরিয়ার ৭০ শতাংশের বেশি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকার। সরকারের এ সফলতার পেছনে রয়েছে রাশিয়া, ইরান ও হিজবুল্লার সহায়তা। কিন্তু এই গৃহযুদ্ধ দেশটির জীবনব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। যুদ্ধে দেশটির অর্থনৈতিক ভিত্তি একেবারে ভেঙে গেছে। গত বছর লেবাননের ব্যাংক ব্যবস্থায় ধস নামায় সিরিয়ার মুদ্রার মান আরও পড়ে যায়। এতদিন সিরিয়া বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগের জন্য লেবাননকে কাজে লাগাতে পারতো, যা এখন অনেকটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। সিরিয়ায় এখনও যারা চাকরিবাকরি করছেন, তাদের গড় মাসিক বেতন ৫০ হাজার সিরিয়ান পাউন্ড। গত বছরের শেষ দিকে এর মূল্যমান ছিল ৫০ ব্রিটিশ পাউন্ডের সমান। আর এখন তা নেমে এসেছে ১২ ব্রিটিশ পাউন্ডে। এএফপি বলছে, সিরিয়ার পাউন্ড এক দশকে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য হারিয়েছে।
.
.
এর প্রেক্ষিতে সিরিয়ার শেষ মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট ফোর্ড বলছেন, রাশিয়া মিত্র হিসেবে যে সিরিয়াকে পেয়েছে তা অর্থনৈতিকভাবে খুবই দুর্বল, এবং এ ব্যাপারে কিছু করার উপায় তাদের নেই। একটা বিরাট মৃত পাখির মত সিরিয়া রাশিয়ার গলায় পেঁচিয়ে আছে। আসাদ সরকারের বন্ধু বা শত্রু – কারোরই হাতে এখন এমন শত শত কোটি টাকা নেই যা দিয়ে সিরিয়াকে আবার গড়ে তোলা যাবে।
.
.
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক মানবিক সহায়তা সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সিরিয়া যুদ্ধের আর্থিক ক্ষতি ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। এই যুদ্ধ যদি এখনই শেষ হয়, তাহলেও ২০৩৫ সাল নাগাদ তার ক্ষতির মূল্য আরও ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার হবে। শুধু, তা-ই নয়, যুদ্ধের কারণে সিরিয়ার শিশুদের আয়ুষ্কাল ১৩ বছর কমেছে। সিরিয়ায় ১০ বছরের গৃহযুদ্ধে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা বিবেচনায় নিয়ে তাকে মানবতার জন্য এক লজ্জার দশক হিসেবে অভিহিত করেছেন নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের (এনআরসি) মহাসচিব জ্যান এজল্যান্ড। এই যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি দেখে তাকে একটি ‘সীমাহীন যুদ্ধ’ (এন্ডলেস ওয়ার) বলে অভিহিত করেছেন উইন উইদাউট ওয়ার সংগঠনের অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর স্টিফেন মাইলস। এমতাবস্থায় বিবাদমান শক্তিগুলোর আলোচনার ভিত্তিতে সংকট নিরসনের কোন বিকল্প নেই। আর সব পক্ষকে আলোচনার টেবিলে বসাতে সর্বাধিক কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে, যা মানবতার ইতিহাসের এই লজ্জাজনক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটিয়ে কোটি মানুষকে নতুন জীবন দান করতে পারে।
অপরদিকে আমেরিকার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ২০১৩ সালে আসাদবিরোধীদের অস্ত্র, তহবিল ও প্রশিক্ষণের জন্য গোপন কর্মসূচি চালু করে। কর্মসূচির খবর ফাঁস হয়ে হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায় এর কার্যক্রম। তখন শোনা গিয়েছিল, সিআইএ ৫০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। ২০১৪ সালে তারা আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরু করে। বিশ্লেষকেরা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আইএস প্রতিষ্ঠা করে একসাথে সিরিয়া ও ইরাকে নিজেদের প্রবেশ নিশ্চিত করে। এটি অনেকটা সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে নির্মিত ‘বাস্তিল ডে’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যের মতো: যেখানে দেখা যায় বোমা হামলাকারীকে তালাশ করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এক বাড়ির সিলিংয়ে বোমা রেখে নিজেরাই হইচই শুরু করে দেয় ‘বোমা পাওয়া গিছে, বোমা পাওয়া গিয়েছে’ বলে।
.
.
আবার কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, ওবামা প্রশাসনের সিরিয়া ও ইরাকে ঔদাসীন্যের কারণেই আইএসের উদ্ভব হয় এবং এর সুযোগে উক্ত অঞ্চলে রাশিয়া-ইরান-তুরস্ক আধিপত্য বিস্তারের খেলায় মেতে উঠে। এই খেলায় যুক্তরাষ্ট্র তুলনামূলক পিছিয়ে থাকা এবং খরচের তুলনায় লাভের অংশ নগণ্য বিধায় ট্রাম্প প্রশাসন তার শাসনামলের শেষ দিকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেন। তাঁর এই পিছু হঠার সিদ্ধান্তকে অনেকেই সমর্থন করেছিলেন। যেমন ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে ২৫ জানুয়ারি প্রকাশিত এক কলামে মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট রবার্ট এস. ফোর্ড বলেন, ছয় বছরে ২৬০ কোটি ডলার খরচ করার পর উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় আমেরিকা যেসব অনুগত যোদ্ধা তৈরি করেছে তারা নিজেদেরকে রক্ষা করতে সক্ষম নয়। এরা আমেরিকার সুরক্ষায় রয়েছে কিন্তু প্রতিবেশী শত্রুদের হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারবে না। ফলে স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল আমেরিকার সম্পদ ও রসদের ওপর নির্ভরশীল থাকবে। এ অবস্থায় তিনি সিরিয়া থেকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে সেনা প্রত্যাহারের পরামর্শ দেন।
![]() |
সিরিয়া সংকট |
তবে বাইডেন বর্তমান বিশ্বের সর্বাধিক নৃশংস তিনটি যুদ্ধপ্রবণ দেশ ইরাক, সিরিয়া ও আফগানিস্তানে নতুনভাবে যুদ্ধ পরিচালনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আফগান-তালেবান চুক্তি অনুসারে আগামী মে মাসের মধ্যেই আফগান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের যে প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে, তা বিলম্বিত হতে পারে বলে জানিয়েছেন বাইডেন। অপরদিকে ইরাকে নতুন মার্কিন ঘাঁটি তৈরি ও চার হাজার আইএস যোদ্ধার অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে পরিস্থিতি এখনো ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে সেখানে নতুনভাবে সেনা রাখার যৌক্তিকতা প্রদর্শন করছে মার্কিন প্রশাসন। এছাড়া ইরাকে নতুন করে আট গুণ ন্যাটো সেনা বাড়ানোর ঘোষণাও দিয়েছে বাইডেন। সর্বশেষ সিরিয়ায় নতুনভাবে মার্কিন সেনা জমায়েত, ইরানি বাহিনীর উপর হামলা, নতুন ঘাঁটি নির্মাণের খবর প্রচারিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। এছাড়া সম্প্রতি মার্কিন সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে নতুনভাবে সংগঠিত করা এবং তুরষ্ককে বারংবার সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একসাথে লড়াই করার আহবান জানাচ্ছে বাইডেন প্রশাসন। মোদ্দ কথা, তুরষ্ককে সাথে নিয়ে সিরিয়ায় শেষ মরণ কামড় বসাতে চায় বাইডেন প্রশাসন। তবে এটি যথেষ্ট কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হবে বৈকি। কেননা রাশিয়া এখনো তুরস্ককে যথাযথ মর্যাদায় নিজের হাতে রেখেছে। সম্প্রতি পুতিনের পক্ষ নিয়ে এরদোয়ানকে বাইডেনের নিন্দায়ও দেখা গেছে। এছাড়াও তুরস্ক-রাশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ বিক্রির পাশাপাশি ২০১৮ সালে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক ২৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল, যা আগামী কয়েক বছরেই ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চাচ্ছে তারা।
.
.
ভৌগলিক অবস্থানগত এবং তিন আব্রাহামিক রিলিজিয়ন অনুসারীদের নিকট গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় পার্শ্ববর্তী ইহুদি, শিয়া ও সুন্নি রাষ্ট্রগুলো সিরিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের খেলায় ছাড় দিতে নারাজ। মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয় গৃহযুদ্ধের আগে অত্র অঞ্চলজুড়ে ছিল মার্কিনিদের একচ্ছত্র আধিপত্য। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে সিরিয়ায় সরকার পক্ষের হয়ে আইএস দমনের অজুহাতে বিমান হামলার মাধ্যমে রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সর্ববৃহৎ হস্তক্ষেপের সূচনা করে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে রাশিয়া তার সামরিক উপদেষ্টা এবং স্পেশাল অপারেশন ফোর্সকেও সিরিয়াতে মোতায়েন করে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সিরিয়ায় সামরিক বাহিনী আলেপ্পোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম বড় একটি জয় পায়। এরপর থেকে এফএসএর নিয়ন্ত্রণ এলাকার সংখ্যা কমতে শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় সিরিয় পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে শুরু করে, দোদুল্যমান আসাদ সরকারের ক্ষমতার আসন স্থিতিশীল হওয়ার পাশাপাশি বিদ্রোহীদের বিপক্ষে আসাদ সরকারের অবস্থানও ক্রমশ শক্তিশালী হতে শুরু করে।
![]() |
সিরিয়া সংকট |
আসাদের সরকারের ক্ষমতা সুসংহত করার লক্ষ্যে রাশিয়া এখন পর্যন্ত সিরিয়ায় ৫,০০০ সৈন্য ও কয়েক ডজন যুদ্ধ বিমান প্রেরণ করেছে। এর মাধ্যমে তারা সিরিয়ার তারতাস বন্দর ও ভূমধ্যসাগরে নিজেদের নৌবহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। এভাবে খুব সামান্য বিনিয়োগের মাধ্যমেই রাশিয়া সিরিয়ার সাথে বন্ধুত্ব সৃষ্টির পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতেও সক্ষম হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর প্রথমবারের মতো বিশ্বাঙ্গণে তারা একটি বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের ফলেই। উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও জর্ডানের সঙ্গে সিরিয়ার যুদ্ধবিরতির নেতৃত্ব দিয়েছে মস্কো। এরপর ইদলিব ইস্যুতে তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি করেছে ২০১৮ সালে। ২০১৯ সালে সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে গেলে আরও একটি চুক্তি করে তারা। এছাড়া সিরিয়ায় ইরানের উপস্থিতি নিয়ে ইসরায়েলের মধ্যে যে উদ্বেগ সেটি নিয়েও ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছেন ভ্লাদিমির পুতিন।
.
.
আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে 2017 সালের আস্তানা সম্মেলনে ইরান-তুরস্ক-রাশিয়া চারটি ডি-এস্কেলেশন জোনের উল্লেখ করে, যার তিনটি ইতোমধ্যেই দখল করা হয়েছে। সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ ইদলিব শহর দখল সম্ভব হয়নি এখনো। ইদলিবের আশেপাশে আরো বিস্তীর্ণ এলাকা মার্কিন ও বিদ্রোহী বাহিনীর দখলে রয়েছে, তাই ইদলিব উদ্ধার ব্যতীত বাকি অঞ্চল দখল করা সম্ভ নয়। এছাড়াও জর্ডান থেকে সিরিয়ার ভেতর দিয়ে তুরস্ক যাওয়ার "এম ফাইভ" হাইওয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ পড়েছে ইদলিবে। তাই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইদলিব উদ্ধারে ত্রিশক্তি জোর তৎপরতা শুরু করেছে।
.
.
এদিকে গত কয়েক বছরে সিরিয়া সংকট সমাধানে রাশিয়ার উদ্যোগে যতটুকু আশার আলো দেখেছিল সিরিয়রা, তা যেন আজ পুনরায় মৃয়মান হতে চলেছে মার্কিন নয়া মধ্যপ্রাচ্য নীতির প্রভাবে। ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত রাশিয়া-তুরষ্ক-ইরান-কাতারের বৈঠকে সিরিয়া সংকট সমাধানে যেসব অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়েছিল, তাতে পানি ঢেলে দিয়ে নয়া যুদ্ধনীতি নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ট্রাম্প নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর গর্বের সাথে বলেছিলেন, "আমি আমার শাসনামলে কোন নতুন যুদ্ধ শুরু করিনি, উল্টো যুদ্ধপ্রবণতা কমিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রগুলোকে সঙ্কুচিত করেছি।" এই কথার মাধ্যমে তিনি হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলেন, আপনারা আপনাদের পছন্দের প্রেসিডেন্টের আমলে এর বিপরীত দৃশ্য দেখবেন। পর্যবেক্ষণেও দেখা যাবে, বারাক ওবামার শাসনামলে যুদ্ধ নীতি প্রণয়নে বাইডেনই বেশি ভূমিকা রেখেছিলেন এবং বর্তমানেও তৎকালীন যুদ্ধপ্রিয় ব্যক্তিবর্গকেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক আসনে বসানো হয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের পর বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোও এরবিল, সুলায়মানিয়া, হাসাকেহ, কোবানি ও মানবিজ এলাকায় আতশবাজি ফুটিয়ে বাইডেনের জয়ে উল্লাস করেছিল। তারা মূলত বাইডেনের জয়কে ওবামা প্রশাসনের হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তন এবং ওয়াশিংটনের ক্ষমতাবৃত্তের জয় হিসেবে দেখেছিল। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন তাদের কখনো বন্ধু হিসেবে দেখেনি, বরং সিরিয়ায় মার্কিন পেট্রল কোম্পানির পাহারাদার হিসেবে দেখেছিল। আর এই ইচ্ছাকে বাস্তবেও রূপ দিয়েছে সিরিয়ান কুর্দিরা। গত গ্রীষ্মে মার্কিন এক তেল কোম্পানির সঙ্গে এসডিএফের চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। বিনিময়ে পেট্রল বিক্রির এই অর্থের পাশাপাশি মার্কিনরা ২০২০ সালে ৩০০ মিলিয়ন এবং ২০২১ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে ২০০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য বরাদ্দ করেছে এসডিএফের জন্য। বিপুল পরিমাণ এই আর্থিক ও সামরিক সাহায্যের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান বাইডেন প্রশাসনের মদদ নতুনভাবে মার্কিন আধিপত্য বিস্তারেরই ইঙ্গিত বৈকি।
![]() |
সিরিয়া সংকট |
বর্তমানে সিরিয়ার ৭০ শতাংশের বেশি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকার। সরকারের এ সফলতার পেছনে রয়েছে রাশিয়া, ইরান ও হিজবুল্লার সহায়তা। কিন্তু এই গৃহযুদ্ধ দেশটির জীবনব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। যুদ্ধে দেশটির অর্থনৈতিক ভিত্তি একেবারে ভেঙে গেছে। গত বছর লেবাননের ব্যাংক ব্যবস্থায় ধস নামায় সিরিয়ার মুদ্রার মান আরও পড়ে যায়। এতদিন সিরিয়া বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগের জন্য লেবাননকে কাজে লাগাতে পারতো, যা এখন অনেকটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। সিরিয়ায় এখনও যারা চাকরিবাকরি করছেন, তাদের গড় মাসিক বেতন ৫০ হাজার সিরিয়ান পাউন্ড। গত বছরের শেষ দিকে এর মূল্যমান ছিল ৫০ ব্রিটিশ পাউন্ডের সমান। আর এখন তা নেমে এসেছে ১২ ব্রিটিশ পাউন্ডে। এএফপি বলছে, সিরিয়ার পাউন্ড এক দশকে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য হারিয়েছে।
.
.
এর প্রেক্ষিতে সিরিয়ার শেষ মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট ফোর্ড বলছেন, রাশিয়া মিত্র হিসেবে যে সিরিয়াকে পেয়েছে তা অর্থনৈতিকভাবে খুবই দুর্বল, এবং এ ব্যাপারে কিছু করার উপায় তাদের নেই। একটা বিরাট মৃত পাখির মত সিরিয়া রাশিয়ার গলায় পেঁচিয়ে আছে। আসাদ সরকারের বন্ধু বা শত্রু – কারোরই হাতে এখন এমন শত শত কোটি টাকা নেই যা দিয়ে সিরিয়াকে আবার গড়ে তোলা যাবে।
.
.
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক মানবিক সহায়তা সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সিরিয়া যুদ্ধের আর্থিক ক্ষতি ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। এই যুদ্ধ যদি এখনই শেষ হয়, তাহলেও ২০৩৫ সাল নাগাদ তার ক্ষতির মূল্য আরও ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার হবে। শুধু, তা-ই নয়, যুদ্ধের কারণে সিরিয়ার শিশুদের আয়ুষ্কাল ১৩ বছর কমেছে। সিরিয়ায় ১০ বছরের গৃহযুদ্ধে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা বিবেচনায় নিয়ে তাকে মানবতার জন্য এক লজ্জার দশক হিসেবে অভিহিত করেছেন নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের (এনআরসি) মহাসচিব জ্যান এজল্যান্ড। এই যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি দেখে তাকে একটি ‘সীমাহীন যুদ্ধ’ (এন্ডলেস ওয়ার) বলে অভিহিত করেছেন উইন উইদাউট ওয়ার সংগঠনের অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর স্টিফেন মাইলস। এমতাবস্থায় বিবাদমান শক্তিগুলোর আলোচনার ভিত্তিতে সংকট নিরসনের কোন বিকল্প নেই। আর সব পক্ষকে আলোচনার টেবিলে বসাতে সর্বাধিক কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে, যা মানবতার ইতিহাসের এই লজ্জাজনক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটিয়ে কোটি মানুষকে নতুন জীবন দান করতে পারে।
0 comments:
Post a Comment
Please do not enter any spam link in the comment box.