মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ ইরাকের ঐতিহাসিক নৃশংতার শিকার হওয়ার ১৮ বছর পূর্ণ হলো গত ১৯ মার্চ। এই দীর্ঘ আঠারো বছরের কালো ইতিহাস তৈরি হয়েছে দশ লক্ষ শহিদ ও তার দ্বিগুণ বিকলাঙ্গের রক্ত ও আর্তনাদের মাধ্যমে। যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে মার্কিনিরা আঠারো বছর আগে একটি সমৃদ্ধ দেশকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করার পদক্ষেপ নিয়েছিল, তা কতটা সফল এবং কার্যকর হয়েছে বিশ্ব মানবতাকে আজ খতিয়ে দেখতে হবে।
.ইরাকে শান্তি ফিরবে কবে?
.২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন হামলার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সম্প্রসারণবাদী সাদ্দাম হোসেনকে হটিয়ে নতুন গণতান্ত্রিক পুতুল হরকার বসানোর মাধ্যমে ইরানে প্রভাব বিস্তার করা। কিন্ত যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধপরবর্তী মার্কিন হঠকারী সিদ্ধান্ত ইরানের জন্য শাপে বর হয়ে দাড়িয়েছে। সাদ্দাম হোসেন ইরানের যোগ্য প্রতিপক্ষ হিসেবে আরব বিশ্ব ও পশ্চিমাদের মদদপুষ্ট ছিলেন বৈকি, কিন্তু তার সম্প্রসারণবাদি নীতি ও সমরাস্ত্র উন্নয়নের বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে আমলে নিয়ে তুলনামূলক আরো যোগ্য ব্যক্তিকে ইরাকের মসনদে বসাতে ইরাকে হামলা চালায় মার্কিন জোট। এই উদ্দেশ্য উপলব্ধি করেই ইরাক হামলায় ইরান যথেষ্ট ভীত এবং সংবেদনশীল ছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল বাগদাদের পর মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন পরবর্তী টার্গেট হবে তেহরান। এর প্রক্ষিতেই সাদ্দামের পতনের পর ইরানের মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেলিজেন্স, কুদস ফোর্স ও অভিজাত আইআরজিসির গোয়েন্দা বিভাগ ইরাকে ব্যাপকভাবে তৎপর হয়, যার ফলস্বরূপ আজ ইরাকের সমস্ত রাষ্ট্রীয় সংগঠনে ইরানি মদদপুষ্টদের জয়জয়কার দেখছে বিশ্ব।
.
.
যুদ্ধের মাধ্যমে ইরাকের সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিয়ে তা পুনর্গঠনের দায়িত্ব একজন অনভিজ্ঞ ব্যক্তির হাতে দিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে প্রথম ও বড় ভুলটি করে। সাদ্দামের পতনের পর ইরাকে 'ভাইসরয়' নিয়োগ করা হয় হেনরি কিসিঞ্জারের অনুজ ডানপন্থী লেফেটেনেন্ট পল ব্রেমারকে, যিনি কূটনীতিবিদ হলেও মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে কখনো এর আগে আসেননি এবং ইরাকি রাজনীতি সম্পর্কে ছিলেন অনভিজ্ঞ। ফলে তার প্রথম পদক্ষেপ হয়, সাদ্দামের বাথ পার্টিকে জার্মানির নাৎসি বাহিনীর সাথে তুলনা করে তাদের নির্মূল করা। এই 'ডিবাথিফিকেশন' প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইরাকের সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয়। এই পদক্ষেপ সম্পর্কে পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী পরলোকগত সাংবাদিক অ্যান্থনি শাদিদ ইরাক যুদ্ধের উপর রচিত তাঁর বই 'Night Draws Near'-এ লিখেছিলেন, "ব্রেমারের এই সিদ্ধান্তের যে ফলাফল ছিল, তা সাড়ে তিন লাখ ইরাকি অফিসার এবং সৈন্যকে রাস্তায় বসিয়ে দেয়। এই লোকগুলোর প্রত্যেকের কিছু না কিছু সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল। ফলে, মুহূর্তের মধ্যে গেরিলা যুদ্ধের জন্য সম্ভাব্য প্রার্থীর এক বিশাল ভাণ্ডার তৈরি হয়ে যায়। (তাদের দখলে এবং নাগালের মধ্যে ছিল প্রায় এক মিলিয়ন টন অস্ত্র এবং সবধরনের গোলাবারুদ।)" সে সময় নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মার্কিন সেনা কর্মকর্তা বলেছিলেন, "সে সপ্তাহেই আমরা ইরাকের মাটিতে সাড়ে চার লাখ নতুন শত্রু সৃষ্টি করেছিলাম।"ব্রেমারের এই সিদ্ধান্তের ফলে খুব দ্রুত কিছু সশস্ত্র জঙ্গী সংগঠন গড়ে উঠে, যা পরবর্তীতে নতুনভাবে গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটায়। এসব গোষ্ঠীর প্রধান টার্গেট হয়ে দাড়ায় দখলদার মার্কিন বাহিনী ও তাদের সমর্থক শিয়া সম্প্রদায়। এই পেক্ষাপটে সীমান্তবর্তী সুন্নি গোষ্ঠিগুলোকে সক্রিয় হতে না দেয়া ও শিয়াদের রক্ষা করে সহানুভূতি অর্জনে ইরান সক্রিয় হতে শুরু করে।
.
.
ইরাকে সামাজিক অস্থিরতা যে অবশ্যম্ভাবী, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় তা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন সাদ্দাম হুসাইন। তাই আমেরিকান বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর সিআইএ’র কর্মকর্তাদের একবার বলেছিলেন, ”শোন হে! এই দেশ নিয়ন্ত্রণ করা তোমাদের কর্ম নয়। আমার মতো কাউকে খুঁজে তার হাতে ক্ষমতা দিয়ে দিও। “
.
.
২০১১ সালে বিশ্বের নিন্দার মুখে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। ঠিক তখন থেকেই ইরাককে 'ক্লায়েন্ট এস্টেটে' পরিণত করার দুর্ধর্ষ খেলায় সর্বাত্মক জনবল নিয়োগ করে ইরান। এর স্বীকারোক্তি বা প্রমাণ পাওয়া যায় ২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বরে প্রকাশিত এক ইরানি গোয়েন্দা ডকুমেন্টে। এই দিন বিখ্যাত অনুসন্ধানী সংবাদ মাধ্যম "দ্য ইন্টারসেপ্ট" ও "নিউয়র্ক টাইমস" ৭০০ পৃষ্টার একটি ইরানি গোয়েন্দা ডকুমেন্ট ফাঁস করে তথ্য-প্রমাণ সহকারে। ডকুমেন্টে দেখা যায়, ২০১১ সালে সৈন্য প্রত্যাহারের সময় এত বছর যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে কাজ করা ইরাকি এজেন্টদের পুনর্বাসন ব্যতিত অনিরাপদ ও নিঃস্ব অবস্থায় ছুঁড় ফেলে দেয় মার্কিনিরা। তারা চলে যাওয়ার পর এসব এজেন্ট মার্কিন সোর্স হওয়ার অপরাধে আক্রমণের আশঙ্কায় ভুগতে থাকে, আর এসব ভীত-সন্ত্রস্ত এজেন্টদের হাত করতে ইরান ব্যাপক অর্থ খরচ করে। ফলে অনেকেই ইরানের সাথে যুক্ত হয়ে ইরাকে সিআইএ'র অবস্থান, কলাকৌশল ও স্পর্শকাতর তথ্যসমূহ ইরানি মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেলিজেন্স এন্ড সিকিউরিটি'র নিকট হস্তান্তর করে।
ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টগুলো থেকে ইরাকের যে চিত্র পাওয়া যায়, তা এক অর্থে ২০০৩ সালের আমেরিকার আগ্রাসনেরই ফলাফল। ইরাক আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে আমেরিকা বাস্তবে দেশটির নিয়ন্ত্রণ ইরানের হাতেই তুলে দিয়েছিল - এই মত এখন ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, এমনকি মার্কিন সেনাবাহিনীর ভেতরেও। ২০১৯ সালে মার্কিন সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রকাশিত ইরাক যুদ্ধের উপর দুই ভলিউমের একটি পর্যালোচনামূলক গবেষণাপত্রে ইরাকে আমেরিকানদের ভুলগুলোর এবং ইরাক যুদ্ধের অকল্পনীয় ব্যয় ও প্রাণহানির সমালোচনা করা হয়। ঐ যুদ্ধে প্রায় ৪,৫০০ আমেরিকান এবং কয়েক লাখ ইরাকি মারা গিয়েছিল, আর আমেরিকার খরচ হয়েছিল প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার। কয়েকশো পৃষ্ঠার ঐ গবেষণাপত্রের উপসংহার টানা হয় এই বলে যে, "সাহসী এবং সম্প্রসারণবাদী ইরানই এই যুদ্ধের একমাত্র বিজয়ী।"
.
.
ইরাকের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ে ইরানি মদদপুষ্টদের ভয়াবহ অবস্থান সম্পর্কে "ইরান ক্যাবল" নামরণকৃত উক্ত নথিতে উল্লেখ রয়েছে। এর সর্বাধিক বৃহৎ ও সাম্প্রতিক প্রভাব দেখা যায়, সোলেমানি হত্যার মাত্র কয়েক দিনের মাথায় যখন ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের বিল ইরাকের পার্লামেন্টে পাশ করানো হয়। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে ইরান মধ্যপ্রাচ্য থেকে, বিশেষত ইরাক থেকে মার্কিন সেনা নির্মূলের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
.
.
কয়েক দশক ধরে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ইরাকি কূটনীতির সম্মুখভাগে দায়িত্ব পালন করা সাদ্দাম হুসেনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী তারেক আজিজ আমেরিকার ইরাক আক্রমণের প্রায় একমাস আগে বাগদাদের অফিসে বসে ইরাকের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ জানিয়েছিলেন, "আমেরিকা সাদ্দাম হুসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে।বাথ পার্টিকে এবং সেক্যুলার আরব জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করে দিতে পারে। " কিন্তু সেইসাথে তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন, সাদ্দামকে ক্ষমতাচ্যুত করার মধ্য দিয়ে "আমেরিকা একটা প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দেবে, যা তারা আর কখনোই বন্ধ করতে পারবে না।" তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, আরব জাতীয়তাবাদের আড়ালে সাদ্দামের বজ্রমুষ্টির শাসনব্যবস্থাই কেবল পারে আল-কায়েদার মতো শক্তিগুলোকে কিংবা ইরানের প্রভাবকে মোকাবেলা করতে। বন্দী অবস্থাতেই ২০১৫ সালের জুন মাসে তিনি হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু মৃত্যুর আগেই তিনি দেখে যেতে পেরেছিলেন, কিভাবে তার প্রতিটি ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়েছিল। মৃত্যুর পূর্বে তিনি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিরুদ্ধে "ইরাককে নেকড়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে যাওয়ার" অভিযোগ করেছিলেন।
২০১৪ সালে আবির্ভূত বিশ্বের সর্বাধিক নৃশংস ও ভয়ানক জঙ্গী গোষ্ঠীর আবির্ভাবের পেছনেও মার্কিনিদের ব্যর্থতা ও ইরানি কার্যক্রমকে দায়ী করা হয়। ইরাকের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নূর আল-মালিকির 'ড্রাকোনিয়ন নীতি' ও দীর্ঘদিন ব্যাপী সুন্নিদের উপর পরিচালিত ব্যাপক নির্যাতনের ভিত্তিতেই ২০১৪ সালের গ্রীষ্মকালে এক নৃশংস ঘটনার মাধ্যমে আইসিসের উত্থান দেখে বিশ্ববাসী। জুনের শুরুতে তারা ইরাকের গুরুত্বপূর্ণ মসুল শহর দখল করে নেয় এবং তার কয়েকদিনের মাথায় ১,৫০০ এর বেশি ইরাকি সেনা হত্যার ভিডিও প্রকাশ করে। দুঃখজনকভাবে ১২ লক্ষ মানুষের শহরটিতে ৩০,০০০ সেনা মোতায়েন থাকলেও মাত্র ১,৫০০ আইএস কর্মীর আক্রমণে সেনারা শহরের নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে বাধ্য হয়। জুনের শেষে সংগঠনের নেতা বাগদাদি নিজেকে খলিফা ও অধিকৃত অঞ্চল নিয়ে খেলাফত ঘোষণা করে। পরবর্তীতে গোষ্ঠীটি ইরাকের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নিলে মার্কিনিরা পুনরায় সৈন্য পাঠানোর প্রস্তুতি শুরু করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের যুদ্ধ পরবর্তী পরিকল্পনার অভাব ও একটি দেশকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করার দায় এড়াতে আইএসের উত্থানের কারণ হিসেবে ইরাকের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অত্যাধিক সুন্নি নির্যাতনকে দায়ী করে এবং সেনা মোতায়েনের আগে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে।
.
.
এসময় প্রশিক্ষণ নিয়ে আইএস বিরোধী যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে আইএসের তান্ডব পরিচালিত এলাকাসমূহ থেকে দলে দলে মানুষ ইরান সীমান্তে ছুটে আসতে শুরু করে। এতে ইরান এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করে। প্রথমত এদের মাধ্যমে ইরান নিজেদের মদদপুষ্ট সশস্ত্র মিলিশিয়া গোষ্ঠী তৈরি করে; দ্বিতীয়ত আইএসের শিয়া নির্যাতন বন্ধে দ্রুত ভূমিকা রাখতে পারে। উল্লেখ্য যে, আইএস সর্বপ্রথম যে কুর্দি শহর মাখমুরে "ব্ল্যাক টাইগার" নামক কুর্দি গেরিলাদের হাতে পরাজয়ের স্বাদ বরণ করে, তাতেও ইরান সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল। একজন কুর্দি বিশ্লেষকের মতে, "আইএস হামলার কয়েকদিন আগেই আমরা ইরানি কারিগরি, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সহায়তা পেয়েছিলাম, কিন্তু যুদ্ধ শুরু আরো এক-দুই দিন পর মার্কিনিরা আসে। এর কারণ ইরানি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা আমলাতান্ত্রিক।" আইএস বিরোধী অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানকে একসাথে লড়াই করতে দেখা গেলেও ইরাকে পুনরায় মার্কিন সশস্ত্র উপস্থিতি নিয়ে ইরান ছিল যথেষ্ট সন্দিহান।
.
.
অভিযান শেষে ভগ্নপ্রায় ইরাক পুনর্গঠনে ইরান যে পন্থা অবলম্বন করে তা ছিল যথেষ্ট গণবিচ্ছিন্ন ও ঘৃণিত। কাশেম সোলেমানির নেতৃত্বাধীন ইরানি কুদস ফোর্সের নৃশংস কার্যক্রম সর্বপ্রথম ফুটে উঠে ইরাকের জুরফ আল-সাখার এলাকার কৃষিভিত্তিক সম্প্রদায়ের সুন্নিদের উপর পরিচালিত গণহত্যার মাধ্যমে। সোলেমানির এসব কর্মকান্ডে যেমন নড়েচড়ে বসেছিল মার্কিন প্রশাসন, তেমনি চিন্তিত ছিল খোদ ইরানের মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেলিজেন্স। এজন্যেই এখনো অনেকে প্রশ্ন তোলেন, সোলেমানিকে ইরাকে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছিল, তা তিনি আদৌ কতটুকু প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন?
ইরাকে ইরানের প্রয়োগকৃত নীতি যে কতটা অগ্রহণযোগ্য হয়েছে তা ২০১৯ সালের আন্দোলনে ইরাকি যুবকদের মাঝে ফুটে উঠেছিল।এপর্যন্ত ৬০০ ইরাকি ক্ষমতাসীনদের বুলেটে প্রাণ দিয়ে ইরানি প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে একটি প্রকৃত স্বাধীন ইরাক প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা জানান দিয়েছে পৃথিবীকে। সাদ্দামের সাথে যে আরব জাতীয়তাবাদের দাফন হয়েছিল, স্বাধীনতা ফিরে পেতে তা পুনরিজ্জীবত করতে চায় তরুণেরা।
.
.
পরিস্থিতি অনুযায়ী স্বীকার করতেই হয়, বর্তমানে ইরাকের সব খাতে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ইরানের প্রভাবই বেশি। একইভাবে সিরিয়ায়ও মার্কিন বাহিনী অনেকটা কোণঠাসা। কিন্তু নতুন বাইডেন প্রশাসন হারানো অধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছেন। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের আইনকে পাশ কাটাতে তিনি ইরাকে ন্যাটো সেনা আট গুণ বাড়াচ্ছেন, যেখানে এখনই ন্যাটোর ৫০০ ও যুক্তরাষ্ট্রের আড়াই হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছে।
.
.
গত মাসে ইরাকের একটি সামরিক সূত্রের বরাত দিয়ে আল-জাদিদ গণমাধ্যম জানায়, কুর্দিস্তানের রাজধানীএরবিলের কাছে আল-হারির সামরিক ঘাঁটিতে সম্প্রসারণের কাজ করছে মার্কিন সেনারা এবং গত দুই মাস ধরে এই কাজ চলছে। ইরাকের গোয়েন্দা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মার্কিন বাহিনী সেখানে ভূগর্ভস্থ আশ্রয় কেন্দ্র, গোলা-বারুদের গুদাম এবং সামরিক ব্যারাক প্রতিষ্ঠা করছে। তিনি আরো জানান যে, গত কয়েক মাস ধরে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে মার্কিন বাহিনী যে অভিযান চালিয়েছে এ ঘাঁটি তার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করেছে। এছাড়াও মার্কিন সেনা অবস্থানের পক্ষে বিশ্ববাসীর সামনে যৌক্তিকতা তুলে ধরতে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ৪,০০০ আইএস সদস্য সমাবেশের তথ্য নিশ্চিত করেছে ইরাকি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সাবা আল আকিলি। এরই প্রেক্ষিতে গত ২১ জানুয়ারী বাগদাদে ভয়াবহ আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে ২৮ জন হত্যা ও দেড় শতাধিক মানুষ আহত করার মাধ্যমে আইএস নিজ উপস্থিতি জানান দেয়, এছাড়াও হঠাৎ ইরানি মিলিশিয়াদের সাথেও বিভিন্ন গোষ্ঠী উত্তেজনামূলক আচরণ করছে। তবে ইরানও পোপের সফল ভ্রমণ সম্পাদনের মাধ্যমে ইরাকের নিরাপত্তা পরিস্থিতি, শিয়া প্রভাব ও ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষার ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে।
.
.
এমতাবস্থায় যুদ্ধের আঠারো বছর পরে দশ লক্ষ শহিদ, পঞ্চাশ লক্ষ অনাথ ও বিশ লক্ষ বিধাবা ধারণকারী এক সময়কার সমৃদ্ধ ইরাকের তরুণ সমাজ আজ ধ্বংসের মুখে পড়েছে। তারা পায়নি কোন শিক্ষা, বেড়ে উঠছে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে, দু'মুঠো খাবার যোগাতে হাতে তুলে নিতে হচ্ছে অস্ত্র। এহেন পরিস্থিতিতেও সাম্প্রতিক ইরানি ও মার্কিন আগ্রাসি পরিকল্পনার সম্মুখে দাড়িয়ে ইরাকি যুব সমাজ জানতে চায়, ইরাকে শান্তি ফিরবে কবে?
যুদ্ধের মাধ্যমে ইরাকের সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিয়ে তা পুনর্গঠনের দায়িত্ব একজন অনভিজ্ঞ ব্যক্তির হাতে দিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে প্রথম ও বড় ভুলটি করে। সাদ্দামের পতনের পর ইরাকে 'ভাইসরয়' নিয়োগ করা হয় হেনরি কিসিঞ্জারের অনুজ ডানপন্থী লেফেটেনেন্ট পল ব্রেমারকে, যিনি কূটনীতিবিদ হলেও মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে কখনো এর আগে আসেননি এবং ইরাকি রাজনীতি সম্পর্কে ছিলেন অনভিজ্ঞ। ফলে তার প্রথম পদক্ষেপ হয়, সাদ্দামের বাথ পার্টিকে জার্মানির নাৎসি বাহিনীর সাথে তুলনা করে তাদের নির্মূল করা। এই 'ডিবাথিফিকেশন' প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইরাকের সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয়। এই পদক্ষেপ সম্পর্কে পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী পরলোকগত সাংবাদিক অ্যান্থনি শাদিদ ইরাক যুদ্ধের উপর রচিত তাঁর বই 'Night Draws Near'-এ লিখেছিলেন, "ব্রেমারের এই সিদ্ধান্তের যে ফলাফল ছিল, তা সাড়ে তিন লাখ ইরাকি অফিসার এবং সৈন্যকে রাস্তায় বসিয়ে দেয়। এই লোকগুলোর প্রত্যেকের কিছু না কিছু সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল। ফলে, মুহূর্তের মধ্যে গেরিলা যুদ্ধের জন্য সম্ভাব্য প্রার্থীর এক বিশাল ভাণ্ডার তৈরি হয়ে যায়। (তাদের দখলে এবং নাগালের মধ্যে ছিল প্রায় এক মিলিয়ন টন অস্ত্র এবং সবধরনের গোলাবারুদ।)" সে সময় নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মার্কিন সেনা কর্মকর্তা বলেছিলেন, "সে সপ্তাহেই আমরা ইরাকের মাটিতে সাড়ে চার লাখ নতুন শত্রু সৃষ্টি করেছিলাম।"ব্রেমারের এই সিদ্ধান্তের ফলে খুব দ্রুত কিছু সশস্ত্র জঙ্গী সংগঠন গড়ে উঠে, যা পরবর্তীতে নতুনভাবে গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটায়। এসব গোষ্ঠীর প্রধান টার্গেট হয়ে দাড়ায় দখলদার মার্কিন বাহিনী ও তাদের সমর্থক শিয়া সম্প্রদায়। এই পেক্ষাপটে সীমান্তবর্তী সুন্নি গোষ্ঠিগুলোকে সক্রিয় হতে না দেয়া ও শিয়াদের রক্ষা করে সহানুভূতি অর্জনে ইরান সক্রিয় হতে শুরু করে।
.
.
ইরাকে সামাজিক অস্থিরতা যে অবশ্যম্ভাবী, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় তা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন সাদ্দাম হুসাইন। তাই আমেরিকান বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর সিআইএ’র কর্মকর্তাদের একবার বলেছিলেন, ”শোন হে! এই দেশ নিয়ন্ত্রণ করা তোমাদের কর্ম নয়। আমার মতো কাউকে খুঁজে তার হাতে ক্ষমতা দিয়ে দিও। “
.
.
২০১১ সালে বিশ্বের নিন্দার মুখে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। ঠিক তখন থেকেই ইরাককে 'ক্লায়েন্ট এস্টেটে' পরিণত করার দুর্ধর্ষ খেলায় সর্বাত্মক জনবল নিয়োগ করে ইরান। এর স্বীকারোক্তি বা প্রমাণ পাওয়া যায় ২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বরে প্রকাশিত এক ইরানি গোয়েন্দা ডকুমেন্টে। এই দিন বিখ্যাত অনুসন্ধানী সংবাদ মাধ্যম "দ্য ইন্টারসেপ্ট" ও "নিউয়র্ক টাইমস" ৭০০ পৃষ্টার একটি ইরানি গোয়েন্দা ডকুমেন্ট ফাঁস করে তথ্য-প্রমাণ সহকারে। ডকুমেন্টে দেখা যায়, ২০১১ সালে সৈন্য প্রত্যাহারের সময় এত বছর যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে কাজ করা ইরাকি এজেন্টদের পুনর্বাসন ব্যতিত অনিরাপদ ও নিঃস্ব অবস্থায় ছুঁড় ফেলে দেয় মার্কিনিরা। তারা চলে যাওয়ার পর এসব এজেন্ট মার্কিন সোর্স হওয়ার অপরাধে আক্রমণের আশঙ্কায় ভুগতে থাকে, আর এসব ভীত-সন্ত্রস্ত এজেন্টদের হাত করতে ইরান ব্যাপক অর্থ খরচ করে। ফলে অনেকেই ইরানের সাথে যুক্ত হয়ে ইরাকে সিআইএ'র অবস্থান, কলাকৌশল ও স্পর্শকাতর তথ্যসমূহ ইরানি মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেলিজেন্স এন্ড সিকিউরিটি'র নিকট হস্তান্তর করে।
![]() |
যুক্তরাষ্ট্র-ইরাক দ্বন্দ্ব |
ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টগুলো থেকে ইরাকের যে চিত্র পাওয়া যায়, তা এক অর্থে ২০০৩ সালের আমেরিকার আগ্রাসনেরই ফলাফল। ইরাক আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে আমেরিকা বাস্তবে দেশটির নিয়ন্ত্রণ ইরানের হাতেই তুলে দিয়েছিল - এই মত এখন ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, এমনকি মার্কিন সেনাবাহিনীর ভেতরেও। ২০১৯ সালে মার্কিন সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রকাশিত ইরাক যুদ্ধের উপর দুই ভলিউমের একটি পর্যালোচনামূলক গবেষণাপত্রে ইরাকে আমেরিকানদের ভুলগুলোর এবং ইরাক যুদ্ধের অকল্পনীয় ব্যয় ও প্রাণহানির সমালোচনা করা হয়। ঐ যুদ্ধে প্রায় ৪,৫০০ আমেরিকান এবং কয়েক লাখ ইরাকি মারা গিয়েছিল, আর আমেরিকার খরচ হয়েছিল প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার। কয়েকশো পৃষ্ঠার ঐ গবেষণাপত্রের উপসংহার টানা হয় এই বলে যে, "সাহসী এবং সম্প্রসারণবাদী ইরানই এই যুদ্ধের একমাত্র বিজয়ী।"
.
.
ইরাকের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ে ইরানি মদদপুষ্টদের ভয়াবহ অবস্থান সম্পর্কে "ইরান ক্যাবল" নামরণকৃত উক্ত নথিতে উল্লেখ রয়েছে। এর সর্বাধিক বৃহৎ ও সাম্প্রতিক প্রভাব দেখা যায়, সোলেমানি হত্যার মাত্র কয়েক দিনের মাথায় যখন ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের বিল ইরাকের পার্লামেন্টে পাশ করানো হয়। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে ইরান মধ্যপ্রাচ্য থেকে, বিশেষত ইরাক থেকে মার্কিন সেনা নির্মূলের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
.
.
কয়েক দশক ধরে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ইরাকি কূটনীতির সম্মুখভাগে দায়িত্ব পালন করা সাদ্দাম হুসেনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী তারেক আজিজ আমেরিকার ইরাক আক্রমণের প্রায় একমাস আগে বাগদাদের অফিসে বসে ইরাকের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ জানিয়েছিলেন, "আমেরিকা সাদ্দাম হুসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে।বাথ পার্টিকে এবং সেক্যুলার আরব জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করে দিতে পারে। " কিন্তু সেইসাথে তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন, সাদ্দামকে ক্ষমতাচ্যুত করার মধ্য দিয়ে "আমেরিকা একটা প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দেবে, যা তারা আর কখনোই বন্ধ করতে পারবে না।" তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, আরব জাতীয়তাবাদের আড়ালে সাদ্দামের বজ্রমুষ্টির শাসনব্যবস্থাই কেবল পারে আল-কায়েদার মতো শক্তিগুলোকে কিংবা ইরানের প্রভাবকে মোকাবেলা করতে। বন্দী অবস্থাতেই ২০১৫ সালের জুন মাসে তিনি হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু মৃত্যুর আগেই তিনি দেখে যেতে পেরেছিলেন, কিভাবে তার প্রতিটি ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়েছিল। মৃত্যুর পূর্বে তিনি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিরুদ্ধে "ইরাককে নেকড়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে যাওয়ার" অভিযোগ করেছিলেন।
![]() |
যুক্তরাষ্ট্র-ইরাক দ্বন্দ্ব |
২০১৪ সালে আবির্ভূত বিশ্বের সর্বাধিক নৃশংস ও ভয়ানক জঙ্গী গোষ্ঠীর আবির্ভাবের পেছনেও মার্কিনিদের ব্যর্থতা ও ইরানি কার্যক্রমকে দায়ী করা হয়। ইরাকের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নূর আল-মালিকির 'ড্রাকোনিয়ন নীতি' ও দীর্ঘদিন ব্যাপী সুন্নিদের উপর পরিচালিত ব্যাপক নির্যাতনের ভিত্তিতেই ২০১৪ সালের গ্রীষ্মকালে এক নৃশংস ঘটনার মাধ্যমে আইসিসের উত্থান দেখে বিশ্ববাসী। জুনের শুরুতে তারা ইরাকের গুরুত্বপূর্ণ মসুল শহর দখল করে নেয় এবং তার কয়েকদিনের মাথায় ১,৫০০ এর বেশি ইরাকি সেনা হত্যার ভিডিও প্রকাশ করে। দুঃখজনকভাবে ১২ লক্ষ মানুষের শহরটিতে ৩০,০০০ সেনা মোতায়েন থাকলেও মাত্র ১,৫০০ আইএস কর্মীর আক্রমণে সেনারা শহরের নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে বাধ্য হয়। জুনের শেষে সংগঠনের নেতা বাগদাদি নিজেকে খলিফা ও অধিকৃত অঞ্চল নিয়ে খেলাফত ঘোষণা করে। পরবর্তীতে গোষ্ঠীটি ইরাকের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নিলে মার্কিনিরা পুনরায় সৈন্য পাঠানোর প্রস্তুতি শুরু করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের যুদ্ধ পরবর্তী পরিকল্পনার অভাব ও একটি দেশকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করার দায় এড়াতে আইএসের উত্থানের কারণ হিসেবে ইরাকের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অত্যাধিক সুন্নি নির্যাতনকে দায়ী করে এবং সেনা মোতায়েনের আগে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে।
.
.
এসময় প্রশিক্ষণ নিয়ে আইএস বিরোধী যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে আইএসের তান্ডব পরিচালিত এলাকাসমূহ থেকে দলে দলে মানুষ ইরান সীমান্তে ছুটে আসতে শুরু করে। এতে ইরান এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করে। প্রথমত এদের মাধ্যমে ইরান নিজেদের মদদপুষ্ট সশস্ত্র মিলিশিয়া গোষ্ঠী তৈরি করে; দ্বিতীয়ত আইএসের শিয়া নির্যাতন বন্ধে দ্রুত ভূমিকা রাখতে পারে। উল্লেখ্য যে, আইএস সর্বপ্রথম যে কুর্দি শহর মাখমুরে "ব্ল্যাক টাইগার" নামক কুর্দি গেরিলাদের হাতে পরাজয়ের স্বাদ বরণ করে, তাতেও ইরান সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল। একজন কুর্দি বিশ্লেষকের মতে, "আইএস হামলার কয়েকদিন আগেই আমরা ইরানি কারিগরি, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সহায়তা পেয়েছিলাম, কিন্তু যুদ্ধ শুরু আরো এক-দুই দিন পর মার্কিনিরা আসে। এর কারণ ইরানি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা আমলাতান্ত্রিক।" আইএস বিরোধী অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানকে একসাথে লড়াই করতে দেখা গেলেও ইরাকে পুনরায় মার্কিন সশস্ত্র উপস্থিতি নিয়ে ইরান ছিল যথেষ্ট সন্দিহান।
.
.
অভিযান শেষে ভগ্নপ্রায় ইরাক পুনর্গঠনে ইরান যে পন্থা অবলম্বন করে তা ছিল যথেষ্ট গণবিচ্ছিন্ন ও ঘৃণিত। কাশেম সোলেমানির নেতৃত্বাধীন ইরানি কুদস ফোর্সের নৃশংস কার্যক্রম সর্বপ্রথম ফুটে উঠে ইরাকের জুরফ আল-সাখার এলাকার কৃষিভিত্তিক সম্প্রদায়ের সুন্নিদের উপর পরিচালিত গণহত্যার মাধ্যমে। সোলেমানির এসব কর্মকান্ডে যেমন নড়েচড়ে বসেছিল মার্কিন প্রশাসন, তেমনি চিন্তিত ছিল খোদ ইরানের মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেলিজেন্স। এজন্যেই এখনো অনেকে প্রশ্ন তোলেন, সোলেমানিকে ইরাকে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছিল, তা তিনি আদৌ কতটুকু প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন?
![]() |
যুক্তরাষ্ট্র-ইরান-ইরাক দ্বন্দ্ব |
ইরাকে ইরানের প্রয়োগকৃত নীতি যে কতটা অগ্রহণযোগ্য হয়েছে তা ২০১৯ সালের আন্দোলনে ইরাকি যুবকদের মাঝে ফুটে উঠেছিল।এপর্যন্ত ৬০০ ইরাকি ক্ষমতাসীনদের বুলেটে প্রাণ দিয়ে ইরানি প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে একটি প্রকৃত স্বাধীন ইরাক প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা জানান দিয়েছে পৃথিবীকে। সাদ্দামের সাথে যে আরব জাতীয়তাবাদের দাফন হয়েছিল, স্বাধীনতা ফিরে পেতে তা পুনরিজ্জীবত করতে চায় তরুণেরা।
.
.
পরিস্থিতি অনুযায়ী স্বীকার করতেই হয়, বর্তমানে ইরাকের সব খাতে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ইরানের প্রভাবই বেশি। একইভাবে সিরিয়ায়ও মার্কিন বাহিনী অনেকটা কোণঠাসা। কিন্তু নতুন বাইডেন প্রশাসন হারানো অধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছেন। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের আইনকে পাশ কাটাতে তিনি ইরাকে ন্যাটো সেনা আট গুণ বাড়াচ্ছেন, যেখানে এখনই ন্যাটোর ৫০০ ও যুক্তরাষ্ট্রের আড়াই হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছে।
.
.
গত মাসে ইরাকের একটি সামরিক সূত্রের বরাত দিয়ে আল-জাদিদ গণমাধ্যম জানায়, কুর্দিস্তানের রাজধানীএরবিলের কাছে আল-হারির সামরিক ঘাঁটিতে সম্প্রসারণের কাজ করছে মার্কিন সেনারা এবং গত দুই মাস ধরে এই কাজ চলছে। ইরাকের গোয়েন্দা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মার্কিন বাহিনী সেখানে ভূগর্ভস্থ আশ্রয় কেন্দ্র, গোলা-বারুদের গুদাম এবং সামরিক ব্যারাক প্রতিষ্ঠা করছে। তিনি আরো জানান যে, গত কয়েক মাস ধরে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে মার্কিন বাহিনী যে অভিযান চালিয়েছে এ ঘাঁটি তার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করেছে। এছাড়াও মার্কিন সেনা অবস্থানের পক্ষে বিশ্ববাসীর সামনে যৌক্তিকতা তুলে ধরতে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ৪,০০০ আইএস সদস্য সমাবেশের তথ্য নিশ্চিত করেছে ইরাকি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সাবা আল আকিলি। এরই প্রেক্ষিতে গত ২১ জানুয়ারী বাগদাদে ভয়াবহ আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে ২৮ জন হত্যা ও দেড় শতাধিক মানুষ আহত করার মাধ্যমে আইএস নিজ উপস্থিতি জানান দেয়, এছাড়াও হঠাৎ ইরানি মিলিশিয়াদের সাথেও বিভিন্ন গোষ্ঠী উত্তেজনামূলক আচরণ করছে। তবে ইরানও পোপের সফল ভ্রমণ সম্পাদনের মাধ্যমে ইরাকের নিরাপত্তা পরিস্থিতি, শিয়া প্রভাব ও ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষার ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে।
.
.
এমতাবস্থায় যুদ্ধের আঠারো বছর পরে দশ লক্ষ শহিদ, পঞ্চাশ লক্ষ অনাথ ও বিশ লক্ষ বিধাবা ধারণকারী এক সময়কার সমৃদ্ধ ইরাকের তরুণ সমাজ আজ ধ্বংসের মুখে পড়েছে। তারা পায়নি কোন শিক্ষা, বেড়ে উঠছে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে, দু'মুঠো খাবার যোগাতে হাতে তুলে নিতে হচ্ছে অস্ত্র। এহেন পরিস্থিতিতেও সাম্প্রতিক ইরানি ও মার্কিন আগ্রাসি পরিকল্পনার সম্মুখে দাড়িয়ে ইরাকি যুব সমাজ জানতে চায়, ইরাকে শান্তি ফিরবে কবে?
0 comments:
Post a Comment
Please do not enter any spam link in the comment box.