বিশ্বে উদিয়মান শক্তি ও ভূ-রাজনৈতিক চাবি হিসেবে যে কয়টি রাষ্ট্র বিবেচিত হয়, তন্মধ্যে তুরষ্ক, ইরান ও পাকিস্তান অন্যতম। উন্নয়ন ও প্রভাব বিস্তারের পথে থাকা বাঁধা-বিপত্তি দূর করতে সম্প্রতি এই তিনটি রাষ্ট্র একত্রে কাজ শুরু করেছে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে। এসব কৌশলের মধ্যে অন্যতম হলো ইউরেশীয় সংস্থা ইকোনমিক কো-অপারেশন অর্গানাজাইশেন (ইকো) সক্রিয় করার মাধ্যমে শক্তিশালী আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
.
.
ইরান-তুরস্ক-পাকিস্তান জোট কোন পথে?
ইকো'র মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল তৈরির ধারাবাহিকতায় গত বছরের ডিসেম্বরে সংস্থাটির পরিবহন ও যোগাযোগ বিভাগের ১০তম বৈঠকে সাড়ে ছয় হাজার কিলোমিটারব্যাপী রেল চলাচলের একটি সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করে ত্রিশক্তি। পৃথিবীর মোট পরিধির এক ষষ্ঠাংশ বিস্তৃত এই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনা স্বপ্নের মত মনে হলেও শীঘ্রই তা বাস্তবে পরিণত করার ইঙ্গিত দিয়েছে সংস্থাটি। গত ৪ মার্চ ইকো'র ১৪তম সামিটে ত্রিশক্তি ও অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্র সমূহের বক্তব্যের মাধ্যমে একটি বৃহৎ নেটোয়ার্ক তৈরির পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়। সামিটে তুরষ্ক ইকো ট্রেড এগ্রিমেন্ট বাস্তবায়নে জোর দেয়ার পাশাপাশি ইকো ব্যাংকের গুরুত্ব তুলে ধরেন। এছাড়া কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট কাশিম জোমার্ট ২০১৮ সালে সৃষ্ট ট্রান্স-কাস্পিয়ান আন্তর্জাতিক পরিবহন রুট সচল করার তাগিদ দেন, যা একাধারে চীন, কাজাখস্তান, জর্জিয়া ও আজারবাইজানকে সংযুক্ত করেছে।
![]() |
ইকোনমিক কো-অপারেশন অর্গানাজাইশেন (ইকো) |
ইকো'র প্রতিষ্ঠাতা দেশ ইরান বিগত বছরগুলোতে তাদের অবকাঠামো নির্মাণে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তা তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত দেয় বটে। ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা ইরান নিজ দেশকে আন্তঃমহাদেশীয় যোগাযোগ ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু বানাতে অনেকগুলো উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ইতোমধ্যেই।
.
.
ইকোর সদস্য রাষ্ট্র আফগানিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তানের কোন সমুদ্র বন্দর না থাকায় ইরান নিজ সমুদ্র বন্দরকে দেশগুলোর আমদানি-রপ্তানি রুট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সর্বশেষ গত ৬ই মার্চ ইরানের পক্ষ থেকে একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রকাশের মাধ্যমে। ইরানের বন্দর ও মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, ওমান সাগরে নির্মাণ করা হবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্ববৃহৎ সমুদ্রবন্দর। তিনি বলেন, "বন্দরের উন্নয়ন এবং বাণিজ্যিক বন্দর প্রতিষ্ঠা করা ইরানের কাছে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ওমান সাগরে বন্দর নির্মাণের এই পদক্ষেপ ইরানের বন্দর ও মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের পক্ষ থেকে একটি কৌশলগত পদক্ষেপ।" একইদিন ইরানের প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসহাক জাহাঙ্গিরি বলেছেন, বর্তমানে ইরানের সঙ্গে প্রায় সারা বিশ্বের রেললাইন সংযুক্ত রয়েছে, ভবিষ্যতে তার দেশের রেললাইন ভূমধ্যসাগরের সঙ্গেও সংযুক্ত হবে। তিনি বলেন, ইরাকের বসরা থেকে শালামচে পার্যন্ত রেল লাইন চালু করার পর সিরিয়ার রেল লাইন পুনঃনির্মাণ করা হবে এবং এর মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে যুক্ত হবে ইরানের রেল লাইন। ফলে যেসব প্রতিবেশী দেশ সমুদ্রবন্দরের অভাবে আন্তর্জাতিক পানিসীমায় প্রবেশ করতে পারে না সেইসব দেশ আমদানি-রপ্তানির কাজে ইরানের সক্ষমতা কাজে লাগাতে পারবে।
.
.
দীর্ঘ পরিকল্পনা ও কূটনৈতিক বাঁধা-বিপত্তি পার করে সম্প্রতি ইরান-পাকিস্তান-তুরষ্ক যে পণ্যবাহী বাণিজ্যিক ট্রেনের যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে ত্রিদেশীয় সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। ইকো'র নেতৃস্থানীয় এই তিন দেশ পাকিস্তান-ইরান-তুরষ্ক যথাক্রমে আরব সাগর ও দক্ষিণ এশিয়া, পারস্য উপসাগর ও মধ্যপ্রাচ্য এবং ভূমধ্যসাগর, মধ্য এশিয়া ও ইউরোপকে একত্রিত করেছে। তাই ত্রিদেশীয় শক্তির এই বাণিজ্য জোট এখন বিশ্বের অন্যতম আলোচনার বিষয়।
১৯৮৫ সালে সৃষ্ট সংস্থা ইকো'র প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য সংখ্যা তিন হলেও তা অল্প সময়ের মাঝেই মধ্য এশিয়ার আরো সাতটি দেশকে সদস্য হিসেবে পেয়েছে। কিন্তু চার দশক আগে সৃষ্ট এই জোট বিগত পাঁচ বছরে এত সক্রিয় হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হলো মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। বিগত বছরগুলোতে মার্কিন ন্যাটোমিত্র খ্যাত তুরষ্কের সাথে যেমন মার্কিন সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে, তেমনি পাকিস্তানের সাথে ঘটেছে সম্পর্ক সঙ্কোচন। এর প্রেক্ষিতেই ইরানের তত্ত্বাবধানে ইকো সক্রিয় করেছে তিন রাষ্ট্র, যার পেছনে মূল ভূমিকা রাখছে চীন। জাপানি বিখ্যাত নিউজ ম্যাগাজিন নিক্কি এশিয়া'র মতে, উদ্বোধন হওয়া সাড়ে ছয় হাজার কিলোমিটারব্যাপী রেলপথটি চীনের শিনজিয়াং প্রদেশ পর্যন্ত পৌঁছে তা বেল্ড এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এর সাথে সংযুক্ত হবে। এছাড়া ৪ই মার্চের ইকো সামিটেও তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান বলেছেন, তারা ২০১৩ সালে চীনা রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের সমন্বয়ে গঠিত চীনের বিআরআই খুঁজে পেয়েছেন এবং স্বীকার করেছেন যে তারা "উইন-উইন" নীতির ভিত্তিতে এই উদ্যোগকে সমর্থন করবেন।
.
.
ইরানে ২৬০০, তুরষ্কে ১৯৫০ ও পাকিস্তানে ১৯৯০ কিলোমিটার বিস্তৃত আলোচিত রেলপথটি ২১ দিনের ভ্রমণকে মাত্র ১২ দিনে সম্ভবপর করে তুলে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।গত বুধবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের অর্থ ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা আবদুর রাজ্জাক দাউদ জানান, "ট্রেনটির একদিক থেকে সফর শেষ করে গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগবে ১২ দিন এবং প্রতিটি ট্রেনে ৭৫০ টন পণ্য পরিবহন করা যাবে। তিন দেশের মধ্যে ইকো ট্রেন চালু মূলত বন্ধুত্বেরই নিদর্শন।"
.
.
বহুল আলোচিত এই রেলপথটি এমন সময় সক্রিয় হতে যাচ্ছে, যখন বাইডেন প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাংদেহী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো শুরু করেছে এবং ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তিতে সহজে না ফেরার ইঙ্গিত দিচ্ছে বিভিন্ন শর্তের মাধ্যমে। কিন্তু মার্কিনিদের নতুন এই কৌশলকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ৩রা মার্চ ইরান ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে পরমাণু ইস্যুতে আর কোন আলোচনা হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। এছাড়া গত মাসের শেষ সপ্তাহে বাইডেন প্রশাসন সর্বপ্রথম মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়ায় ইরান সমর্থনপুষ্ট গোষ্ঠীর উপর হামলা চালিয়ে সতর্কবাণী প্রচার করেছে। এর জবাবেই গত ৩রা মার্চ সকালে ইরাকের মার্কিন ঘাঁটিতে বিদ্রোহীরা রকেট হামলা চালায়। অতি সম্প্রতি তুরষ্কের প্রতিও নিষেধাজ্ঞা দিতে ১৭০ জন মার্কিন আইনপ্রণেতা প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে চিঠি দিয়েছে।এর থেকে বোঝা যায় যে, ট্রাম্প আমলে সৃষ্ট মার্কিন তিক্ততা সহজে কাটবে না। আর এর প্রস্তুতিতেই ইরান-তুরষ্ক-পাকিস্তান ইকোর অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্য রুট চালু করতে যাচ্ছে, যা অদূর ভবিষ্যতে চীনের জন্য হবে আশির্বাদ স্বরূপ। চীনও প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। তাদের স্বপ্নের বেল্ট এন্ড রোড প্রকল্পে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপকে সংযুক্ত করে শক্তিশালী নৌ-যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে ইরানের কৌশলগত চাবাহার বন্দর ও পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দরের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে চীন।
.
.
গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ইরানের জাতীয় সংসদের স্পীকার ড• লারিজানির বক্তব্যে সর্বপ্রথম মার্কিন বিরোধী জোট ও তাদের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়। তিনি সবার সামনে ইরান-তুরষ্ক-রাশিয়া জোটকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের বিকল্প হিসেবে উল্লেখ করেন, একইসাথে এই জোটে যোগ দিতে পাকিস্তান ও চীনকে আহ্বান জানান। এর প্রাসঙ্গিকতা ও সার্থকতার প্রমাণ পাওয়া যায় সাম্প্রতিক ইরান-রাশিয়া ও তুরষ্ক-পাকিস্তান সামরিক মহড়ার মাধ্যমে। অতি সম্প্রতি তুরষ্ক ও পাকিস্তান যৌথভাবে যুদ্ধ বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের সিদ্ধান্তও আনুষ্ঠানিকভাবে গোষণা দিয়েছে।
.
.
এই বছর মার্কিন মুল্লুকে বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে রুশ-মার্কিন সম্পর্কে টানাপোড়েন বৃদ্ধি পায়, যার প্রেক্ষিতে বিরোধী দলীয় নেতাকে বিষ প্রয়োগ ও গ্রেফতারের অভিযোগ এনে রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বাইডেন সরকার। অপরদিকে উইঘুর নির্যাতন ইস্যুকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও বিশ্বে চীনের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাসকরণে যথাযথভাবেই ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও আরো দুটি দেশে উইঘুর নির্যাতনকে গণহত্যা আখ্যা দিয়ে বিল পাশ করেছে। অপরদিকে মিয়ানমারে জান্তা সরকারের অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রথম বৈঠকে চীন ও দ্বিতীয় বৈঠকে চীনের সাথে রাশিয়ারও ভেটো দেয়ার মাধ্যমে বোঝা যায় যে, এশিয়ায় মার্কিনিদের হস্তক্ষেপ অকার্যকর করতে চীন-রাশিয়া ঐক্যবদ্ধ হতে পারে বৈকি।
.
.
পরিশেষে বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে বলা যায় যে, চীন এবং রাশিয়া নিজ স্বার্থেই এশিয়া ও ইউরোপে ইকো'র কার্যক্রম বিস্তৃত করতে মদদ দেবে, যা অত্র অঞ্চলে মার্কিনিদের কোণঠাসা করতে যথেষ্ট কার্যকর হবে বলে ধারণা করা যায়। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রশক্তিকে কিভাবে ব্যবহার করে এবং কী ধরনের কৌশল অত্র অঞ্চলে অবলম্বন করে, তাই এখন দেখার বিষয়।
.
.
দীর্ঘ পরিকল্পনা ও কূটনৈতিক বাঁধা-বিপত্তি পার করে সম্প্রতি ইরান-পাকিস্তান-তুরষ্ক যে পণ্যবাহী বাণিজ্যিক ট্রেনের যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে ত্রিদেশীয় সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। ইকো'র নেতৃস্থানীয় এই তিন দেশ পাকিস্তান-ইরান-তুরষ্ক যথাক্রমে আরব সাগর ও দক্ষিণ এশিয়া, পারস্য উপসাগর ও মধ্যপ্রাচ্য এবং ভূমধ্যসাগর, মধ্য এশিয়া ও ইউরোপকে একত্রিত করেছে। তাই ত্রিদেশীয় শক্তির এই বাণিজ্য জোট এখন বিশ্বের অন্যতম আলোচনার বিষয়।
![]() |
পাকিস্তান-ইরান-তুরষ্কের ইকো |
১৯৮৫ সালে সৃষ্ট সংস্থা ইকো'র প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য সংখ্যা তিন হলেও তা অল্প সময়ের মাঝেই মধ্য এশিয়ার আরো সাতটি দেশকে সদস্য হিসেবে পেয়েছে। কিন্তু চার দশক আগে সৃষ্ট এই জোট বিগত পাঁচ বছরে এত সক্রিয় হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হলো মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। বিগত বছরগুলোতে মার্কিন ন্যাটোমিত্র খ্যাত তুরষ্কের সাথে যেমন মার্কিন সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে, তেমনি পাকিস্তানের সাথে ঘটেছে সম্পর্ক সঙ্কোচন। এর প্রেক্ষিতেই ইরানের তত্ত্বাবধানে ইকো সক্রিয় করেছে তিন রাষ্ট্র, যার পেছনে মূল ভূমিকা রাখছে চীন। জাপানি বিখ্যাত নিউজ ম্যাগাজিন নিক্কি এশিয়া'র মতে, উদ্বোধন হওয়া সাড়ে ছয় হাজার কিলোমিটারব্যাপী রেলপথটি চীনের শিনজিয়াং প্রদেশ পর্যন্ত পৌঁছে তা বেল্ড এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এর সাথে সংযুক্ত হবে। এছাড়া ৪ই মার্চের ইকো সামিটেও তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান বলেছেন, তারা ২০১৩ সালে চীনা রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের সমন্বয়ে গঠিত চীনের বিআরআই খুঁজে পেয়েছেন এবং স্বীকার করেছেন যে তারা "উইন-উইন" নীতির ভিত্তিতে এই উদ্যোগকে সমর্থন করবেন।
.
.
ইরানে ২৬০০, তুরষ্কে ১৯৫০ ও পাকিস্তানে ১৯৯০ কিলোমিটার বিস্তৃত আলোচিত রেলপথটি ২১ দিনের ভ্রমণকে মাত্র ১২ দিনে সম্ভবপর করে তুলে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।গত বুধবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের অর্থ ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা আবদুর রাজ্জাক দাউদ জানান, "ট্রেনটির একদিক থেকে সফর শেষ করে গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগবে ১২ দিন এবং প্রতিটি ট্রেনে ৭৫০ টন পণ্য পরিবহন করা যাবে। তিন দেশের মধ্যে ইকো ট্রেন চালু মূলত বন্ধুত্বেরই নিদর্শন।"
.
.
বহুল আলোচিত এই রেলপথটি এমন সময় সক্রিয় হতে যাচ্ছে, যখন বাইডেন প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাংদেহী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো শুরু করেছে এবং ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তিতে সহজে না ফেরার ইঙ্গিত দিচ্ছে বিভিন্ন শর্তের মাধ্যমে। কিন্তু মার্কিনিদের নতুন এই কৌশলকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ৩রা মার্চ ইরান ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে পরমাণু ইস্যুতে আর কোন আলোচনা হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। এছাড়া গত মাসের শেষ সপ্তাহে বাইডেন প্রশাসন সর্বপ্রথম মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়ায় ইরান সমর্থনপুষ্ট গোষ্ঠীর উপর হামলা চালিয়ে সতর্কবাণী প্রচার করেছে। এর জবাবেই গত ৩রা মার্চ সকালে ইরাকের মার্কিন ঘাঁটিতে বিদ্রোহীরা রকেট হামলা চালায়। অতি সম্প্রতি তুরষ্কের প্রতিও নিষেধাজ্ঞা দিতে ১৭০ জন মার্কিন আইনপ্রণেতা প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে চিঠি দিয়েছে।এর থেকে বোঝা যায় যে, ট্রাম্প আমলে সৃষ্ট মার্কিন তিক্ততা সহজে কাটবে না। আর এর প্রস্তুতিতেই ইরান-তুরষ্ক-পাকিস্তান ইকোর অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্য রুট চালু করতে যাচ্ছে, যা অদূর ভবিষ্যতে চীনের জন্য হবে আশির্বাদ স্বরূপ। চীনও প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। তাদের স্বপ্নের বেল্ট এন্ড রোড প্রকল্পে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপকে সংযুক্ত করে শক্তিশালী নৌ-যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে ইরানের কৌশলগত চাবাহার বন্দর ও পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দরের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে চীন।
.
.
গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ইরানের জাতীয় সংসদের স্পীকার ড• লারিজানির বক্তব্যে সর্বপ্রথম মার্কিন বিরোধী জোট ও তাদের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়। তিনি সবার সামনে ইরান-তুরষ্ক-রাশিয়া জোটকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের বিকল্প হিসেবে উল্লেখ করেন, একইসাথে এই জোটে যোগ দিতে পাকিস্তান ও চীনকে আহ্বান জানান। এর প্রাসঙ্গিকতা ও সার্থকতার প্রমাণ পাওয়া যায় সাম্প্রতিক ইরান-রাশিয়া ও তুরষ্ক-পাকিস্তান সামরিক মহড়ার মাধ্যমে। অতি সম্প্রতি তুরষ্ক ও পাকিস্তান যৌথভাবে যুদ্ধ বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের সিদ্ধান্তও আনুষ্ঠানিকভাবে গোষণা দিয়েছে।
.
.
এই বছর মার্কিন মুল্লুকে বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে রুশ-মার্কিন সম্পর্কে টানাপোড়েন বৃদ্ধি পায়, যার প্রেক্ষিতে বিরোধী দলীয় নেতাকে বিষ প্রয়োগ ও গ্রেফতারের অভিযোগ এনে রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বাইডেন সরকার। অপরদিকে উইঘুর নির্যাতন ইস্যুকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও বিশ্বে চীনের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাসকরণে যথাযথভাবেই ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও আরো দুটি দেশে উইঘুর নির্যাতনকে গণহত্যা আখ্যা দিয়ে বিল পাশ করেছে। অপরদিকে মিয়ানমারে জান্তা সরকারের অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রথম বৈঠকে চীন ও দ্বিতীয় বৈঠকে চীনের সাথে রাশিয়ারও ভেটো দেয়ার মাধ্যমে বোঝা যায় যে, এশিয়ায় মার্কিনিদের হস্তক্ষেপ অকার্যকর করতে চীন-রাশিয়া ঐক্যবদ্ধ হতে পারে বৈকি।
.
.
পরিশেষে বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে বলা যায় যে, চীন এবং রাশিয়া নিজ স্বার্থেই এশিয়া ও ইউরোপে ইকো'র কার্যক্রম বিস্তৃত করতে মদদ দেবে, যা অত্র অঞ্চলে মার্কিনিদের কোণঠাসা করতে যথেষ্ট কার্যকর হবে বলে ধারণা করা যায়। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রশক্তিকে কিভাবে ব্যবহার করে এবং কী ধরনের কৌশল অত্র অঞ্চলে অবলম্বন করে, তাই এখন দেখার বিষয়।
0 comments:
Post a Comment
Please do not enter any spam link in the comment box.