বাংলাদেশ-তুরষ্ক সম্পর্কে নতুন সম্ভাবনার দ্বার
দুই দেশের সম্মিলিত বাণিজ্যিক উদ্যোগের বৃহৎ উদাহরণ হল ডেভেলপমেন্ট এইট (ডি-৮) সংগঠন। তুর্কি উদ্যোগে সৃষ্ট ১৯৯৭ সালে উন্নয়নশীল আটটি দেশের মাঝে অর্থনৈতিক উন্নয়ন জোটের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য বাংলাদেশ।
তুরষ্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সর্বপ্রথম ২০১০ সালে বাংলাদেশ সফর করেন এবং একই বছর তাঁর প্রধানমন্ত্রীও সফর করেন। এর প্রেক্ষিতে ২০১২ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তুরষ্ক সফরে যান। এরপর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক ভালই ছিল, কিন্তু ২০১৩ থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কার্যক্রমে তুরষ্ক অসন্তুষ্ট হওয়ায় সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তবে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়ে শেখ হাসিনা বার্তা পাঠানোর পর সম্পর্কে শিথিলতা আসতে থাকে। এই অভ্যুত্থানের পর এরদোয়ান অভ্যন্তরীণ ঐক্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সমর্থন বৃদ্ধিতে নতুনভাবে কার্যক্রম শুরু করে। এমতাবস্থায় ২০১৭ সালে ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করতে তুরষ্ক যান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, সেই উসিলায় দুই রাষ্ট্রনায়কের মাঝে একটি ফলপ্রসূ আলোচনা সংগঠিত হয়। এর ফল স্বরূপ ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিকট ত্রাণ নিয়ে ছুটে আসেন তুর্কি রাষ্ট্রপ্রতি ও ফার্স্ট লেডি। তারপর থেকেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় বাংলাদেশের পক্ষে জোড়ালো ভূমিকা রেখে আসছে তুরষ্ক, যা তাদের পুনরায় বাংলাদেশের কাছে নিয়ে এসেছে।
সম্প্রতি রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ বেশ সজাগ হলেও আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে তেমন বেশি সমর্থন আদায় করতে পারছে না বলে জানান বিশ্লেষকরা। তাঁরা এর অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন, পার্শ্ববর্তী ঐতিহাসিক বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের নিরবতা এবং মিয়ানমার ঘেঁষা নীতি। এরপর রয়েছে বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ বিনিয়োগকারী অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনের বিরোধীতা। বাংলাদেশের সাথে ভাল সম্পর্ক থাকার পরও নিরবতা এবং বিরোধীতা করার অন্যতম কারণ হতে পারে, তাদের নিকট বাংলাদেশের গুরুত্ব যথাযথভাবে তুলে ধরতে না পারা। কূটনীতিকদের মতে, বাংলাদেশ যদি বন্ধুরাষ্ট্রগুলোকে নিজের গুরুত্ব ঠিকমত উপলব্ধি করাতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ এই ইস্যুতে সুবিধাজনক অবস্থানে চলে আসবে।
![]() |
বাংলাদেশ-তুরষ্ক সম্পর্ক |
বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর দুমুখো নীতির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের উচিত, তাদের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এনে বহিঃরাষ্ট্রেগুলোর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করে নিত্যনতুন অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করা। আর তা বাস্তবায়নে অন্যতম কার্যকরী পদক্ষেপ হতে পারে তুরষ্কের সাথে সার্বিক সম্পর্ক বৃদ্ধি। বর্তমানে তুরষ্ক একটি উদীয়মান আঞ্চলিক শক্তি, তাদের থেকে বাংলাদেশ বাণিজ্যিক এবং প্রতিরক্ষাগত সুবিধা ভোগ করতে পারে। যেহেতু সেন্টমার্টিন দ্বীপসহ বিভিন্ন সীমান্ত নিয়ে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন, সেহেতু বাংলাদেশকে আঞ্চলিক পরিস্থিতিতে নিজের অবস্থান শক্ত করতে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতেই হবে অদূর ভবিষ্যতে। আর প্রতিরক্ষা সরঞ্জামে তুর্কি সমরাস্ত্রগুলো এখন বিশ্বনন্দিত এবং সুলভ মূল্যের। এই সুযোগ কাজে লাগালে বাংলাদেশের চাইনিজ অস্ত্রনির্ভরতাও হ্রাস পাবে।
দুই দেশের অর্থনৈতিক লেনদেন খেয়াল করলে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬৩১ দশমিক ৬৩ মিলিয়ন ডলার তুরষ্কে রপ্তানি করে এবং আমদানি করে ২১২ দশমিক ৩০ মিলিয়ন ডলার। এছাড়াও বাংলাদেশে বর্তমানে অনেকগুলো বড় প্রকল্প শুরু হচ্ছে এবং হবে, এতে তুর্কি কন্স্ট্রাকশন কোম্পানিগুলোও বিনিয়োগ করতে চায় বলে সম্প্রতি জানিয়েছে তুরষ্ক। উল্লেখ্য যে, বিশ্বব্যাপী কনস্ট্রাকশনের জন্য চীনের পর তুর্কি কোম্পানিগুলো বিখ্যাত।
গত দুই বছরে বাংলাদেশ-তুরষ্ক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে দুই দেশে ইতোমধ্যেই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ পর্যায়ে অনেকগুলো বৈঠক হয়েছে। ২০১৯ সাল, একই বছরের ২৩ জানুয়ারি, ১২ এপ্রিল ও ২২ নভেম্বর দুই দেশের বৃহৎ ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোর মাঝে মোট তিনটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনার আয়োজনে প্রধান ভূমিকা রাখে তুরষ্কের ইকতিল্লি শিল্পাঞ্চল ও হাসিয়াড শিল্পাঞ্চল এবং বাংলাদেশের এফবিসিসিআই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীতে নেলসন মেন্ডেলা এবং ইয়াসির আরাফাতের সাথে তুর্কি রাষ্ট্রপতি সুলায়মান দেমিরেল বাংলাদেশ এসেছিলেন ১৯৯৭ সালে। সেই ধারাবাহিকতায় এই বছর বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তীতেও আসতে যাচ্ছেন তুর্কি রাষ্ট্রনায়ক এরদোয়ান। এর পাশাপাশি সম্প্রতি দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সফরে যে নতুন সম্ভাবনাগুলো উন্মোচিত হয়েছে, তন্মধ্যে দুই দেশের অর্থনৈতিক লেনদেন এক বিলিয়ন থেকে দুই বিলিয়ন ডলারে উন্নিত হওয়া, বাংলাদেশে তুর্কি বানিয়োগ, আরএমজি খাতে সহযোগিতা এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে তুর্কি দৃঢ়তা বৃদ্ধি অন্যতম। এসবের প্রত্যেকটি বিষয়ই বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও তুর্কি অস্ত্র-প্রযুক্তি প্রদানের কথাও উল্লেখ করেছেন তুরষ্কের রাষ্ট্রদূত।
সুতরাং বলা যায় যে, ভিশন-২০২১ এবং রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে তুরষ্ক-বাংলাদেশ সম্পর্ক বেগবান করবে। এর পাশাপাশি সার্বিক বিষয়ে নির্দিষ্ট সীমানায় বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা আবদ্ধ না থেকে তা বহূমাত্রিকভাবে ছড়িয়ে পড়বে বলে ধারণা করা যায়। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের উপস্থিতি শক্তিশালী করা এবং বিনিয়োগের সকল সুযোগ-সুবিধা অর্জন নির্ভর করছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকা এবং সময়োপযোগী কূটনীতি প্রণয়নের উপর, যা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।
0 comments:
Post a Comment
Please do not enter any spam link in the comment box.