মানুষকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে 'সার্বজনীন মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাকে' বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৫০ সাল থেকে বিশ্বের সব দেশগুলো (দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যতিত) ১০ ডিসেম্বর "মানবাধিকার দিবস" পালন করে আসছে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার অন্যতম অর্জন বা সাফল্য হিসেবে ধরা হয় বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের ধারণা ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে এই দিবসের প্রচলনকে। কিন্তু মানবাধিকারের ধারণা বিশ্বব্যাপী প্রচলনের ৭০ বছরে এসেও বিশ্বের কয়টি দেশ এই অধিকারগুলো বাস্তবায়নে কাজ করছে বা এক্ষেত্রে আমরা কতটুকু সফলতা অর্জন করতে পেরেছি তা আমাদের খতিয়ে দেখা উচিত; বিশেষ করে বিশ্বে যখন পূর্বের তুলনায় দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং যুদ্ধ সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন।
বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের হাল হাকিকত
একবিংশ শতাব্দিতে মানব সভ্যতা প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে উত্তরোত্তর সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, কিন্তু এর সাথে আমাদের মাঝে একইভাবে মানবতাবোধের কি আদৌ উন্নয়ন ঘটছে? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর দিকে তাকালেই এক ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখতে পাই। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মাঝে প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে জাতিগত সহিংসতা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং দমন-পিড়ন। সম্প্রতি কাশ্মীরকে নিয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে ভারত-পাকিস্তানের মাঝে। কাশ্মীর সীমান্তে গুলাগুলি থেকে শরু করে মর্টার শেল নিক্ষেপের মাধ্যমে উভয়পক্ষের সীমান্তরক্ষী হত্যা এখন নিত্যদিনের ঘটনা যেন। ভারত অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরে সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনেকে করা হয়েছে গৃহবন্দী। এছাড়াও চলছে বিনা অপরাধে জনগণকে কারারুদ্ধ করাসহ বিভিন্ন অমানুষিক নির্যাতন, যার ফলস্বরূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি সেখানে তৈরি হয়েছে স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপ। এভাবে পৃথিবীর ভূস্বর্গ খ্যাত এই অঞ্চল ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে যুদ্ধপ্রবণ এলাকায়। অপরদিকে পাকিস্তানেও বৃদ্ধি পেয়েছে জাতিগত সহিংসতা। বেলুচিস্তানের বিদ্রোহীগোষ্ঠীগুলোর দৌরাত্ম দিন দিন বাড়ার সাথে সাথে সংঘর্ষও বাড়ছে, বাড়ছে রাজনৈতিক দমন-পিড়নও।
আর এই অঞ্চলের মানবাধিকার পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ নিয়ে যদি আমরা কল্পনা করি, তাহলে মানবাধিকার সংকটে জর্জরিত এক উত্তপ্ত যুদ্ধপ্রবণ এলাকার দৃশ্যই ভেসে উঠে চোখের সামনে। কেননা ভারত যে নাগরিত্ব সংশোধনী বিল পাশ করিয়েছে তাদের আইন সভায়, তা এতদিন করোনার কারণে স্তিমিত থাকলেও বিজেপি সরকার পুনরায় সেটি আগামী মাস থেকে বাস্তবায়ন শুরুর ঘোষণা দিয়েছে। ২০১৯ সালে প্রাথমিকভাবে যে নাগরিক তালিকা প্রণয়ন করেছিল মোদি সরকার, তাতে প্রায় বিশ লক্ষ ভারতীয়কে দেয়া হয় 'বাংলাদেশি' পরিচয়। কিন্তু বাংলাদেশ বা পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তান ভারতের কোন নাগরিককে নিজের দেশে গ্রহণ করার মতো অবস্থাতে নেই, হোক তা শরণার্থী হিসেবেই। এমনিতেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ বেশ অস্বস্তিকর অবস্থায় আছে, তার উপরে যদি নতুন শরণার্থী চাপিয়ে দেয়া হয় তবে তা হবে 'মরার উপর খাঁড়ার ঘা' স্বরূপ। তবে ভারত সরকার বাংলাদেশের উপরে তাদের আইনের কোন প্রভাব পড়বেনা বলে বারংবার অস্বস্ত করলেও, প্রাথমিক তালিকা প্রণয়নের পরপরই আমরা দেখেছি ভারত থেকে কিভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের হার বেড়ে গিয়েছিল হঠাৎ।
এক্ষেত্রে জাতিসংঘের অভিবাসী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছিল, ভারতের নাগরিক তালিকা (এনআরসি), সংশোধিত নাগরিক আইন (সিএএ) ও জনসংখ্যা তালিকা (এনপিআর) পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি যুদ্ধাবস্থাও সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া শুধুমাত্র অমুসলিমদের নতুনভাবে নাগরিকত্ব প্রদানের যে নীতিটি ভারত নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে জাতিগত নিপিড়নই বটে।