আজারবাইজান আর্মেনিয়া যুদ্ধের সমীকরণ
সাধারণত যুদ্ধে সৈন্যরা জীবন বাজি রেখে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যাতে লড়ে যায়, তার জন্য কর্তৃপক্ষ বা সেনা নায়ক একটি ইস্যু তৈরি করেন। আর এই ইস্যু সৈন্যদের কাছে যুদ্ধের নৈতিকতা স্পষ্ট করে বলেই সেনারা সর্বাত্মক যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে আনে। যেমনটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে হয়েছিল•••প্রথমে পাক আর্মিদের বাঙালিরা হিন্দুদের মদদপুষ্ট পাকিস্তানের শত্রু বলে গণহত্যা চালাতে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পেরেছিল পাক সরকার। পরবর্তীতে কয়েক মাস পর থেকে সেনা সদস্যরা বুঝতে পারে তারা নিরস্ত্র একটি নির্দোষ জাতির উপরে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, ফলে নৈতিকভাবে নিজেদের বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় তাদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। অপরদিকে দেশের জন্যে মুক্তিবাহিনী প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সাহসিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা শুরু করে।
ঠিক একইভাবে আজারবাইজান গতকাল প্রথমে হামলা চালালেও তারা প্রচার করে আর্মেনিয়াই প্রথম হামলা চালিয়ে দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত হেনেছে। তবে এই যুদ্ধে আজারবাইজান আগে থেকেই নৈতিক অবস্থানে আছে আর্মেনিয়ার বিভিন্ন উস্কানিমূলক হামলার কারণে। আর এর প্রমাণ হলো আজারবাইজানের নাগরিকদের যুদ্ধের দাবিতে কিছুদিন আগে প্রেসিডেন্টের বাসভবন ঘেরাও, এমনকি সরকারকে ভীতু বলে তাদের পদত্যাগের আহবান। এর থেকে বোঝা যায় দেশটির অভ্যন্তরেই যুদ্ধের যথেষ্ট যৌক্তিক ভিত্তি সৃষ্টি হয়েছে।
![]() |
আজারবাইজান আর্মেনিয়া যুদ্ধের সমীকরণ |
এখন পর্যন্ত এক দিনের যুদ্ধে উভয়ের যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাতে আজারবাইজানের পাল্লাই প্রথমে ভারী ছিল এবং এটাই স্বাভাবিক। কারণ সমরবিদ্যার নিয়মানুযায়ী, যে শক্তি আক্রমণে যাবে, তার সমরশক্তি শত্রু থেকে দশ গুণ বা কমপক্ষে পাঁচ গুণ বেশি হতে হবে। কারণ যখন যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তখন উভয় পক্ষই আগে নিজের পর্যাপ্ত প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করে, তারপর অন্যকে আক্রমণের কথা চিন্তা করে। সুতরাং যে আক্রমণ করবে, তাকে অবশ্যই শত্রুর সব বাঁধা অতিক্রম করতে হবে। তবে আজারবাইজান ক্ষতি অনেকটা শোধ করে দিয়েছে ইতোমধ্যেই, শুরু হয়েছে তুরষ্কের ড্রোনবাজী। আজারবাইজান এখন পর্যন্ত যে চারটি ভিডিও প্রকাশ করেছে তার অধিকাংশই ড্রোন হামলার। আর হামলার ধরন এবং প্রকৃতি অনুযায়ী বিশ্লেষকরা নিশ্চিত যে এটি তুরষ্কের ক্যারিশমেটিক ড্রোন TB 2, যেটার ব্যবহারে সিরিয়া এবং লিবিয়ায় যুদ্ধ পরিস্থিতি দ্রুত নিজের হাতে নিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয় তুরষ্ক!
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী আজারি আর্মি ৩০ বছর ধরে দখলে থাকা নিজেদের সাতটি গ্রাম দ্রুত সময়ের মধ্যে দখল করে নিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে ছোট অর্জন মনে হলেও যুদ্ধে এটি ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। কারণ আক্রমণের প্রথম দফায় গণিমত (বিজিত সম্পদ) অর্জন করাটা প্রতিটা সৈন্যের জন্য মোটিভেশন হিসেবে কাজ করে এবং মনোবল বাড়িয়ে দেয়। যার ফলস্বরূপ দেখা যায়, এখন পর্যন্ত ছয় শতাধিক আর্মেনিয় সৈন্য নিহত হয়েছে।
![]() |
আজারবাইজান আর্মেনিয়া যুদ্ধের সমীকরণ |
এই যুদ্ধ হয়তো বেশি দূর গড়াবেনা যদি পার্শবর্তী শক্তিগুলো না চায়। তবে এই যুদ্ধের মাধ্যমে কোন ধরনের কিঞ্চিৎ পরিবর্তনও চায়না বহির্শক্তিগুলো, আর তা নিশ্চিত করতে সব চেষ্টাই অব্যাহত রাখবে সবাই। ককেসাস অঞ্চলে জর্জিয়াকে হারানোর পর রাশিয়ার একমাত্র মিত্র হিসেবে আছে এই আর্মেনিয়া, তাই রাশিয়া কোন অবস্থাতেই চাইবেনা রাষ্ট্রটির কোন ক্ষতি কিংবা পরিবর্তন হোক, যা তাদের সামরিক সহায়তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অপরদিকে ইজরায়েলের অন্যতম মিত্র হলো আজারবাইজান। বিশ্বে আজারবাইজান একমাত্র মুসলিম দেশ যাকে ইজরায়েল সমর্থন করে। আজারবাইজানের অস্ত্রের ষাট ভাগে কেনা হয় ইজরায়েল থেকে, অন্যদিকে ইজরায়েলের তেলের চাহিদার বড় একটি অংশ পূরণ করে আজারবাইজান। শোনা যাচ্ছে, যুদ্ধ শুরুর পর ইজরায়েল থেকে একটি লজিস্টিক বিমান আজারবাইজানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে (তুরষ্ক থেকেও একটি গিয়েছে), কিন্তু বিমানে কী ছিল তা জানা যায়নি।
এদিকে জাতিগত এবং ঐতিহাসিক মিত্র তুরষ্ক পূর্বের ঘোষণা অনুযায়ী সর্বাত্মক সহযোগিতাই করছে আজারবাইজানকে। যুদ্ধ শুরুর পর দ্রুত সময়ের মধ্যে সাতটি গ্রাম দখল করে নেয়ার ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা তুর্কি ড্রোনের ক্যারিশমা। একই পরিস্থিতি হয়েছিল এই বছর হওয়া কিছুদিনের সিরিয়া-তুরষ্ক যুদ্ধে, যেখানে বিশ্বের সামনে প্রথম উপস্থাপিত হয় তুরষ্কের ড্রোন সক্ষমতা। এছাড়া লিবিয়ায়ও তুরষ্কের হস্তক্ষেপের পর যেভাবে বিদ্রোহী হাফতার একের পর এক সামরিক ঘাঁটি থেকে পিছু হটে তা কারো অজানা নয়।
তবে সম্প্রতি তুরষ্ক গ্রীসের সাথে যুদ্ধবস্থা থেকে পিছিয়ে এসে চুক্তিতে বসতে সিদ্ধান্ত নেয় এবং ভূমধ্যসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান বন্ধ করে দিতে রাজি হয়। এর অন্যতম কারণ হল ইইউ'র অবরোধ সামলানোর সক্ষমতা তুরষ্কের এখনো হয়নি। অবরোধ ঠেলে নিজেদের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে তাদের কয়েক দশক লেগে যাবে যেটা ইরানের লেগেছে, অথচ তারা ২০২৩ সালেই একটা ভাল অবস্থানে আসতে চায়। এমতাবস্থায় তুরষ্ক নতুন একটি যুদ্ধ জড়িয়ে গেল, আর এই সময়ে তুরষ্কের জন্য ব্যর্থ হওয়ার কোন সুযোগ নেই। যদি বড় যুদ্ধের পর ব্যর্থ হয় তথা আজারবাইজান পরাজিত হয়, তাহলে ফলটা তুরষ্ককেও ভোগ করতে হবে, যার কারণে তারা সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে এবং করছে।
এর বিপরীতে ইরান পক্ষ নিবে ঐতিহাসিক বন্ধু আর্মেনিয়ার। তবে ইরান এখনো ঘোষণা দিয়ে সমর্থন করেনি এবং করবে বলে আশা করা যায়না, কারণ এই পর্যন্ত অধিকাংশ যুদ্ধেই ইরান প্রক্সি ওয়ার পরিচালনা করেছে। ইরান আজারবাইজানের পতন চাওয়ার অন্যতম কারণ হলো আজারবাইজানের ইজরায়েলি বন্ধুত্ব। কথিত আছে, ইরান-আজারবাইজান সীমান্তের আজারবাইজান অংশে মোসাদের অস্থায়ী কার্যালয় আছে, যেখান থেকে ইরানে নাশকতা চালাতে মোসাদ তাদের অপারেশন টিমকে সাহায্য করে। এখানে মজার বিষয় হলো, আর্মেনিয়া খ্রিষ্টান একটি রাষ্ট্র যাকে মার্কিন জাতশত্রু ইরান সমর্থন করে, অপরদিকে আজারবাইজান শিয়া মুসলিম শাসিত হয়েও অপর শিয়া দেশ ইরান তাদের সাপোর্ট করেনা।
সবশেষে আসে খলনায়ক যুক্তরাষ্ট্রের কথা। আপাতত মার্কিনিরা নিরব থাকতে পারে, বা আজারবাইজানকে মুখ্য সমর্থন দিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে। কারণ এই দশকে যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ যুদ্ধ পরিকল্পনাই নিজেদের নাগরিকদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। একাধারে আফাগানিস্তান, সিরিয়া ও ইরাক থেকে পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করেছে তারা। ইরাক ও আফগান থেকে সব সেনা সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা নিজেরাই দিয়েছে, সিরিয়ায়ও সেনা উপস্থিতি কমিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছে তারা। এমতাবস্থায় নির্বাচনের আগে নতুন কোন যুদ্ধে সরাসরি জড়াবেনা ট্রাম্প, নির্বাচনে জয়ী হলে নতুন স্ট্রেটেজি নিয়ে সামরিক সাহায্যসহ এগিয়ে যেতে পারে। কারণ ককেসাস অঞ্চলে রাশিয়ার একমাত্র আধিপত্যের খুঁটি হলো আর্মেনিয়া, যদি এখান থেকে রাশিয়ার থাবা তুলে নেয়া যায় যুদ্ধের মাধ্যমে তাহলে যুক্তরাষ্ট্রেরই লাভ। তাছাড়া এমন যুদ্ধের ব্যয়ভার অন্যান্যগুলোর তুলনায়ও কম হবে।
পরিশেষে যদি সমাধানের দিকে তাকাই, তাহলে বলা যায় যত দ্রুত সম্ভব দুই দেশের মধ্যে রাশিয়া ও তুরষ্কের মধ্যস্থতায় শান্তিচুক্তি হওয়াটাই উত্তম হবে। কারণে এখানে যে দেশই জয়ী হোক, বড় কোন যুদ্ধ শেষে জয় উদযাপনের মত এবং জয়ী রাষ্ট্র হিসেবে মাথা তুলে দাড়ানোর মত শক্তি কারোই থাকবেনা, বরঞ্চ রাষ্ট্রে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি পাবে।
0 comments:
Post a Comment
Please do not enter any spam link in the comment box.