বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ এবং বিশ্লেষণ লেবাননের বিস্ফোরণকে ইজরায়েলি হামলা বলেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। হামলার আগে নেতানিয়াহুর হুঁশিয়ারি, হামলার পর ট্রাম্পের বক্তব্য, সবকিছুই স্পষ্ট। এছাড়াও যে স্থাপনায় মূল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে, তা স্থানীয়দের কাছে আতশবাজির কারখানা বলে পরিচিত হলেও ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক ইজরায়েলি প্রতিবিদনে এটিকে হিজবুল্লাহর অস্ত্র কারখানা হিসেবে নিশ্চিত করা হয়।
হিজবুল্লাহ বনাম ইজরায়েল
তাছাড়া কিছুদিন আগেই হিজবুল্লাহ তাদের একজন নেতাকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে ট্যাংক নিয়ে ইজরায়েল সীমান্তে ঢুকে হামলা করেছে, যার ইজরায়েলি প্রতিক্রিয়া হল বৈরুতের বিস্ফোরণ। যদি উপর্যুক্ত সব আশঙ্কাই সত্যি হয়, তাহলে বলা যায় এটি ইজরায়েলের পক্ষ থেকে হিজবুল্লাহর প্রতি যুদ্ধ আহবান। তাহলে দেখি যুদ্ধটা কেমন হতে পারে, ভারসাম্যপূর্ণ কিনা•••
হিজবুল্লাহকে বিশ্ব রাষ্ট্রবিহীন সর্বাধিক শক্তিধর সামরিক বাহিনী হিসেবে জানলেও ইজরায়েল জানে নিজেদের লজ্জার কারণ হিসেবে। কারণ ২০০০ এবং ২০০৬ সালে ইজরায়েলের মতো একটি দেশ ছোট একটি সামরিক গোষ্ঠীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়, এবং আশ্চর্যজনকভাবে দুইবারই নাকানি চুবানি খেয়ে ইজরায়েল পরাজিত হয়। ২০০৬ সালের ৩৩ দিনব্যাপী যুদ্ধে ইজরায়েলের অহংকার বিশ্বের অন্যতম অত্যাধুনিক ২০০টি মার্কাবা ট্যাংক ধ্বংস করে হিজবুল্লাহ বিশ্বে সাড়া ফেলে দেয়। এর আগে ইজরায়েল বলতো, মার্কাবার মত দানবীয় ট্যাংক কখনো ধ্বংস করা সম্ভব নয়। এই যুদ্ধে ইজারায়েল এত বেশি মার্কাবা হারায় যা তাদের হাতে থাকা ট্যাংকের পাঁচ ভাগের এক ভাগ ছিল।
১৯৪৮ এর পর থেকে নব্বই এর দশক পর্যন্ত ইজরায়েল লেবাননকে প্রতিনিয়ত হুমকি দিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত রাখত, কিন্তু হিজবুল্লাহর উত্থানের পর থেকে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। হিজবুল্লাহর হুমকিতেই ভীত হতে থাকে ইজরায়েল। কারণ হিজবুল্লাহ এমন একটি সংগঠন, যারা ঢাক-ঢোল পেটাতে পছন্দ করেনা, নিজেদের সক্ষমতার বাইরে কথা বলেনা, যা বলে তা করে দেখায়, এটা ইজরায়েলের বিশ্লেষকদেরই মতামত।
২০১৭ সালে হিজবুল্লাহর হাসান নাসরুল্লাহ হাইফা শহর থেকে পারমাণবিক ও রাসায়নিক স্থাপনা সরিয়ে নিতে ইজরায়েলকে হুঁশিয়ারি দিলে তাদের সামরিক মহলে সাড়া পড়ে যায়, এবং সামরিক বিশ্লেষকরা তা বাস্তবায়ন করতে নেতানিয়াহুকে পরামর্শ দেয়, কারণ নাসরুল্লাহ প্রচারণামূলক কোন বক্তব্য দেয় না। পরবর্তীতে স্থাপনা সরানোর পর হিজবুল্লাহ বলে, যেখানেই এই স্থাপনাগুলো নেয়া হোক, তা হিজবুল্লাহর আওতার বাইরে নয়।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইজরায়েলি সামরিক বিশ্লেষক আমস হারেল প্রাকাশ্য বলেন, "ইজরায়েল হিজবুল্লাহর সাথে যুদ্ধে গেলে তারা ইজরায়েলের সব অবকাঠামো তন্ন তন্ন করে ধ্বংস করবে। উত্তর, দক্ষিণ এবং মধ্য ইজরায়েলের সব জায়গাতেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে অবকাঠামো। তিনি বলেন, হিজবুল্লাহর হাতে ৮০ হাজারের বেশি ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা ইসরায়েলের মজুদকৃত ক্ষেপণাস্ত্র থেকে বেশি। আর যুদ্ধে এগুলো হাজারে হাজারে বৃষ্টির মত ছুটে আসবে ইজরায়েলের দিকে, যা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। তিনি আরো বলেন, হিজবুল্লাহ অনেকবারই বলেছে তাদের হামলার প্রধান লক্ষ্যবস্তু ইজরায়েলের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো, আর এটি সত্যি হলে স্থাপনাগুলোই অভ্যন্তরীণ বোমা হয়ে দেখা দেবে এবং ইজরায়েলের মানুষ বেশি মারা যাবে লেবাননের তুলনায়।"
হিজবুল্লাহ বর্তমানে রাজনৈতিকভাবেও শক্তাশালী। লেবানন পার্লামেন্টে তাদের ১২৮ জন প্রতিনিধি এবং ৮ জন মন্ত্রী রয়েছে। তাদের রয়েছে নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনী এবং কমান্ডো বাহিনী। বর্তমানে এক লক্ষেরও বেশি সক্রিয় যোদ্ধা রয়েছে এই সংগঠনের। তাদের সামরিক সক্ষমতা সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রকাশিত তা সামান্যই বলে ধারণা করা হয়। কারণ তারা সব অপারেশন তথ্য এবং সক্ষমতা গোপন রাখে সবসময়।
বলা হয়ে থাকে লেবানন-ইজরায়েল সীমান্তে হিজবুল্লাহ অনেকগুলো টানেল তৈরি করেছে, যা ইজরায়েলের অভ্যন্তরে গিয়ে পৌঁছেছে। এই টানেল খননের অভিযোগ এনে ইজরায়েল ২০১৮ সালে লেবানন সীমান্তে অভিযান পরিচালনা শুরু করেছিল, পরবর্তীতে অজ্ঞাত কারণে তা বন্ধ করে দেয়া হয়।
হিজবুল্লাহর সেনারা উচ্চতর প্রশিক্ষণ পায় ইরানের আইআরজিসি থেকে এবং তাদের সামরিক ব্যায়ের ষাট ভাগ খরচ দেয় ইরান। হিজবুল্লাহর সাথে ফিলিস্তিনের হামাসও উতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমানে ইজরায়েলের নাকের ডগায় অবস্থানকারী ইরানি ঘাঁটি হিসেবে দেখা হয় হিজবুল্লাহকে।
সর্বশেষ ইজরায়েলি গোয়ন্দা তথ্যমতে, "হিজবুল্লাহ সর্বাত্মক যুদ্ধ প্রস্তুতি নিচ্ছে কয়েক বছরের মধ্যে, যা শেষ হলেই তারা যুদ্ধে নামতে পারে।"
আর এই প্রস্তুতি বাঁধাগ্রস্ত করতেই ইজরায়েল বিভিন্ন চোরাগুপ্তা হামলা চালাবে এবং হিজবুল্লাহকে অসম্পূর্ণ প্রস্তুতিতেই যুদ্ধে নামাতে চেষ্টা করবে।
0 comments:
Post a Comment
Please do not enter any spam link in the comment box.